লিখেছেন- শাখা নির্ভানা
মজা বানু জাত ভিখেরি। তাই সবসময় তার সুযোগে থাকতে হয়। কিছু পাবার সুযোগে। ভিক্ষের সুযোগে। বয়স হলেও ধরা যায় না- উপরে জোয়ান, ভেতরে ভাঙাচোরা। এই বানুই একবার প্রায় কেজি খানেক মাংস পেলো। আকিকার মাংস। তাও পেলো টানা চার ঘণ্টা মুন্সীবাড়ীর মাথা-সমান দেয়াল-টানা বড় বাড়ীর মূলফটকে ধন্না দিতে দিতে। ওমপূরের এই মঙ্গার কালে কে তারে মাংস দেয়! মাংস পেলে হবে কি! তেল দিবে কে? নুন না হয় চেয়ে-চিন্তে মেলে, কিন্তু তেল? অবশেষে বুদ্ধি পেল বানু নিজের ঘটে। চৌমাথার আধাবুড়ো কাশেম বেপারী লোক ভাল, ভাল কথা বলে, ভাল কাজ করে- সবাই তারে ভাল জানে, বানুও। মুন্সীবাড়ীর লোকজনও তারে ভাল পায়। সন্ধ্যা হয় হয়। এই সময় কাশেম বেপারীর দোকানে খরিদ্দার থাকে না। একটু আগে চৌদ্দ পেরনো বাবুল ছোকড়াটা পেছন থেকে হুশ করে এসে ফাটা বাঁশের গলায় চমকে দিলো মুদিকে।
-ও ওস্তাদ, একগিগার মোবাইলে গোপনে কী দেখ একা একা?
-যাহ ব্যদ্দপ, মুরুব্বীর মান্য নেই।
মুদির তাড়া খেয়ে দৌড়ে পালালো বাবুল।
ঠিক ঐ সময় বানু গিয়ে ধন্না দিলো মুদীর সামনে। মুদির মুখ রক্ত-লাল। কী এক অচেনা উত্তেজনা সেখানে। এদিক ওদিক সন্ধানী চোখে তাকালো সে, তারপর কিছু সময় কি জানি ভেবে অনেকটা হালকা মেজাজে ফিসফিসিয়ে বললো- শোন, দোকানের ভেতর-ঘরে আমার সাথে ঘন্টাখানেক শুলি তোরে আমি চার আঙ্গুল তেল দেবো- রাজী থাকলি ক।
রাজী হলো ভিখেরি। তার আবার শোয়া- যেখানে রাত, সেইখানে কাত। বয়সী মুদি মজা খুঁজে পেলো মজা বানুর শুকনো শরীরে। বানুর মনের শরীরে একটুখানি পাপ আর ঘেন্না যেন লেগে গেল চিটাগুড়ের আঠার মতন। কাজ শেষ করে বেপারী দুই আঙ্গুল তেল শিশিতে দিয়ে বললো- যাহ এইডে নিয়ে সরে পড়।
যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মজা বানুর মাথায়। চার আঙ্গুল তেলের কথা বলে দুই আঙ্গুল তেল দেবার মতন পাপ সে এই জগত সংসারে আর একটাও খুঁজে পেল না। তাই নিজের প্রতি ঘেন্না তার এখন অনেকখানি কমে এলো। গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যার গদ্যময় বাতাসের গায়ে গা লাগিয়ে হাটতে হাটতে মুদিকে শাপ-শাপান্ত করে সে- মর মুদি মর। কাশেম মুদী মরে না। তার বদলে শ্লেষ মেশানো একটা বাঁকা হাসি হাসে। পাপ আর অধর্মের ভেদাভেদ বুঝতে না পেরে চিৎকার করে উঠে ভিখেরী অসভ্য গলায়- এতবড় পাপীর মাথায় আল্লা তুমি ঠাডা ফেল না কেন?
আশেপাশে ভিখেরির আওয়াজ শোনার মতন তেমন কেউ ছিল না এক আল্লা ছাড়া। তাই রক্ষে। মজা বানুর কথা শুনে সচ্ছল মুদী মুখের কাট-ছাট বাহারি দাড়িতে হাত বুলিয়ে বাঁকা হেসে সাবধানী গলায় বললো- চুপ, সারা জনমের জন্যি চুপ। আল্লার বয়ে গেছে তোর ছেনালি কতা শুনতি।
বিদেয় হয় ভিখেরী। উঁচু নিচু ঠক্কর খাওয়া পথে চলতে চলতে সে ভাবে আর নিজের সাথে বিড়বিড়িয়ে কথা বলে- সত্যিই কি তা’লি ছেনালদের কোন আল্লা থাকতি নেই? সজ্ঞোলে তো সেই একই কতা কয়।
পথ চলতে গিয়ে নতুন এক অন্ত্যজ ভাবের উদয় হয় ভিখারির মনে। চাঁদ যে চাঁদ, তাতেও তো থাকে কত বড় কলঙ্ক। সে তো তবে তার কাছে বিন্দু ছাড়া কিছুই না।