জাতীয় গড় বুদ্ধিমত্তার ফাঁদে


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

একটা দেশের অর্থনীতি বুঝতে গড় মাথাপ্রতি আয় একমাত্র না হলেও একটা অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট। এই গড় যেমন  দেশের অর্থস্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে তেমনি ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক স্বভাবেরও ছবি এঁকে দেয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চরিত্র অনুসারে বাঙলাদেশেও শতকরা দশভাগ মানুষের হাতে নব্বইভাগ সম্পদ কেন্দ্রীভূত। দেশের সম্পদও সীমিত। তাই স্বাভাবিক ভাবে তার গড় মাথাপ্রতি আয় কম হবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অধিকাংশ মানুষের জীবনে অভাব হবে নিত্য সঙ্গী। বিশ্বায়নের কারণে অভাব তার জায়গায় থেকে শুধু বাইরের খোলশ ও মাত্রা পরিবর্তন করেছে মাত্র। অন্যকিছু নয়। অভাব ও অভাববোধ রাতারাতি উবে যায় না। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। এমন জনপ্রিয় প্রবাদও রাতারাতি বদলে যায় না। স্বভাবের এই দোষ গরীব তো বটেই ধনীদের উপরেও প্রভাব বিস্তার করে। দশ পুরুষের বনেদি ধনী পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক স্বভাব আর সদ্য ধনী হওয়া পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক স্বভাব এক নয়। পুরানদের স্বভাবে যে নান্দনিকতার ও সামষ্টিকতার প্রকাশ ঘটে নতুনদের বেলায় তেমন ঘটতে দেখা যায় না। তারপরেও একই সমাজের নব্বই ভাগ অভাবী মানুষের চরিত্রের প্রভাব দশভাগ ধনীর উপরে পড়বেই। তাই তো বাস্তবে দেখা যায়, আমাদের মতন দরীদ্র দেশের ধনীরা হাতে অর্থ পেয়ে একটা সুরম্য প্রাসাদ রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথবা নামের কাঙাল হয়ে লাভজনক সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করে।

অর্থ ও মেধা বা বুদ্ধিমত্তা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বুদ্ধিমত্তার অভাব যেমন অর্থনৈতিক স্বভাবকে নিন্মগামী করে, তেমনি অর্থের অভাবও বুদ্ধি বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। এটা একটা জটিল চক্র। দারিদ্রের দুষ্ট চক্রও বলা যায় তাকে। গড় বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে বলার আগে বুদ্ধিমত্তা জিনিসটা কি তা একটু দেখে নেয়া যেতে পারে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ কি দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারে বাঁধা সেই বিষয়ে অবগতির মাধ্যমে নিজের মেধা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের দ্বারা যখন সে তার সিদ্ধান্তকে সমষ্টির মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে সমর্থ হয়, তখনই বুদ্ধিমত্তার সঠিক মাত্রার ব্যবহার হয়েছে বলে ধরা যায়। বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্স হচ্ছে, বুদ্ধিমত্তা সঞ্জাত সিদ্ধান্তকে কোনভাবে কোনকিছু দিয়ে প্রভাবিত করা যায় না। কাম, ক্রোধ বা লোভের মতন মৌলিক শক্তিশালী প্রভাবক দিয়েও তাকে প্রভাবিত করা যায় না। যদি যায়, তবে সেটা বুদ্ধিমত্তা নয়, অন্যকিছু। একটা জাতির গড় আয় বের করা যত সহজ, গড় বুদ্ধিমত্তা বের করা ততোটা কঠিন। উপরের সংজ্ঞার অলোকে অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড দেখে কিছুটা হলেও তা নির্ণয় করা সম্ভব হতে পারে।

উপরে বর্ণীত বুদ্ধিমত্তার চরিত্র ও বৈশিষ্টের আলোকে দেখা যেতে পারে, আমরা কতটা বুদ্ধিমান অথবা আমাদের গোটা জাতির গড় বুদ্ধিমত্তাই বা কতটা। বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান ও তথ্য কার কতটা আছে, পেশা ভিত্তিক উৎকর্ষতা কার কতটা আছে, শুধুমাত্র তা দিয়ে বুদ্ধিমত্তা নির্ধারিত হয় না। বুদ্ধিমত্তার একটা বড় পরিচয়, সব দ্দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত হওয়া। সেই হিসাবে বাঙালি একটা নিন্ম বুদ্ধিমত্তার জাতি। জাতীয় গড় বুদ্ধিমত্তা তার অনেক নিচে। ঠিক শতকরা দশ ভাগ ধনী লোকের মতন খুব অল্প সংখ্যক বুদ্ধিমান লোক রয়েছে, তাদের সাথে গোটা জাতির শতকরা নব্বই ভাগ মানুষের বুদ্ধিমত্তার গড় করলে সেখানে গড় জাতীয় বুদ্ধিমত্তা কাজ চালিয়ে নেবার মতন মাত্রার বেশ নিচে অবস্থান করে। প্রমান কি? কী হিসাবে সেটা বলা হলো? চলমান ঘটনাসমূহের বাস্তব চিত্র আমাদের এই উপসংহার টানতে সহায়তা করে।

এই প্রসঙ্গে তেলাপোকার নিরাপত্তা স্ট্রাটেজি বিষয়ক একটা ব্যক্তিগত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আমাদের বাড়িতে তেলাপোকার জনসংখ্যা কমিয়ে আনার জন্যে পেষ্ট কন্ট্রোল কম্পানির লোকেরা তিন তিন বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমাকে উপদেশ দেয়, রাতের বেলায় তারা যখন পানি খাওয়ার জন্যে কিচেনে আসে তখন তাদের মারতে হবে এবং এইভাবে তারা আস্তে আস্তে কমে যাবে সংখ্যায়। এই কাজ করতে গিয়ে আমি দেখতে পাই, প্রথম দিকে তারা সরলরৈখিক গতিতে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে বেশী সংখ্যায় আমার হাতে মারা পড়তো। কিছুদিন এইভাবে চালাবার পর লক্ষ করলাম, তারা তাদের নিরাপত্তা স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করছে। তারা এখন আর সরলরেখায় দৌড়ায় না। তারা দৌড়ায় আঁকাবাঁকা সর্পিল পথা। এই বুদ্ধিমান পরিবর্তনের ব্যাখ্যা অনেকটা এমন। সরলরৈখিক পথে স্পর্শক বা ট্যনজেন্ট মাত্র একটা হয়। যা আমার ব্রেইন খুব সহজে হিসাব করে তাকে আঘাত করার কৌশল নির্ধারণ করতে পারে দ্রুত। কিন্তু সর্পিল পথে অসংখ্য স্পর্শক হয়, যা আমার ব্রেইন হিসাব করে আঘাতের কৌশল ততোটা দ্রুততার সাথে নির্ধারণ করতে পারে না। তাই দুয়েকটা তেলাপোকা হাত ফসকে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এর থেকে বুঝা যায়, সামান্য তেলাপোকা আসলে সামান্য নয়। তাদেরও রয়েছে আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা। ইদুরের বেলায়ও একই রকমের নিরাপত্তা বুদ্ধিমত্তা কাজ করে। তাদের এই বুদ্ধিমত্তাকে প্রভাবিত করা যায় চালাকি করে, লোভের ফাঁদ পেতে।  

এবার একটু তুলনা করা যাক আমাদের নিরাপত্তা বুদ্ধিমত্তার সাথে এইসব তুচ্ছ প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তার। মানুষ হিসাবে আমাদের মস্তিষ্ক বেশ সুগঠিত ও সমৃদ্ধ। আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যে আমাদের মাথায় যথেষ্ট পরিমান বুদ্ধিমত্তা রয়েছে বলে মনে করি। আমাদের আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রাণীদের থেকে বেশ একটু বহুমাত্রীক। আমাদের আছে স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা, খাদ্য-নিরাপত্তা, বস্ত্র-নিরাপত্তা, গৃহ-নিরাপত্তা, শিক্ষানিরাপত্তা, বাক-নিরাপত্তা, ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাসহ এমন আরও বহু রকমের নিরাপত্তা, যা শাসক কতৃক নিশ্চিত হয়ে থাকে। এইসব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতন যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও উপায় আমদের রয়েছে। আমাদের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তাও যথেষ্ট পরিমানে আছে সেসব বিষয় নিশ্চিত করতে। বহু রকমের প্রভাবকের দ্বারা আমাদের বুদ্ধিমত্তাজাত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা হয় বা হয়ে যায়। সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে প্রথমতঃ লোভ, দ্বিতীয়তঃ মুর্খতা, তৃতীয়তঃ ভয়। এই লোভ, ভয় ও মুর্খতার ফাঁদ অনেকটা তেলাপোকা ও ইঁদুর ধরার ফাঁদের মতন, যা তাদের লোভের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে মৃত্যুর মত পরিণতি উপহার দেয়। মানুষের বেলায়ও কি একই বিষয় কাজ করছে না? মানুষ তার বিভ্রান্ত বুদ্ধিমত্তার দ্বারা কুশাসকের লোভের ফাঁদে পড়ে মারা যায়। অল্প সংখ্যক সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষ তাদের স্বাধীন বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই জাতীয়-মরণকে ঠেকাতে পারে না। তারাও মাঝে মাঝে প্রভাবিত হয়ে পড়ে নিন্ম গড় বুদ্ধিমত্তার দ্বারা। অধিকাংশ সময় শাসকের ত্রিমাতৃক ফাঁদে পড়ে নিন্ম গড় বুদ্ধিমত্তার মানুষেরা কুশাসক নির্বাচিত করে।

 ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তা কোন আবেগ নয়, তবে ব্রেইনের র‍্যশনাল ও ইরেশনাল পার্টকে সঠিক, সময়োপযোগী, নিরাপদ ও সর্বোচ্চ মানের জাগতিক অবদান রাখতে সহায়তা দেয়। তার এই সহায়তা দানের সক্ষমতা ততো সময় কার্যকর থাকে, যতো সময় ব্রেইনের ইরেশনাল অংশ, বা র-ইমোশন তাকে সম্মোহিত বা প্যারালাইজড করে ফেলতে না পারে। বুদ্ধিকে অবশ করে দেয়ার মতন ছোটখাটো উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। উদাহরণটার নাম ফেইসবুক। এই সময়ে অনেকে কোন কিছু জানা বা বুঝার জন্যে ফেইসবুকের উপরে নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সময়ের একটা বড় অংশ তারা ব্যয় করছে সোশাল মিডিয়ায়। এদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সম্মোহনের প্রাথমিক ধাক্কায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে সস্তা বিনোদনে। এইসব বিনোদনের একটা নমুনা দেয়া যেতে পারে। এক ফেইসবুক সেলিব্রেটী সেদিন দেখলাম একটা স্ট্যটাস দিয়েছে দুটো মাত্র শব্দ সমন্নয়ে- ‘আহা রে’! লিঙ্গ বৈপরীত্যের একটা ব্যাপার আছে মানতে হবে। তাই ভক্তের সমাগম দেখে হিসেব করা গেল, দেড় ঘণ্টায় দুটো শব্দের জন্যে লাইক পড়েছে প্রায় সাত হাজার। কমেন্ট দেড়’শয়ের মতন। শেয়ার ছত্রিশটা। লাইক, কমেন্ট, শেয়ারকে যদি কোন লেখার গুরুত্ব বিচারের নিয়ামক হিসাবে ধরা হয়, তবে সেলিব্রেটির লেখা শব্দগুচ্ছ কতটা গুরুত্ব বহন করেছিল। এবং সেই গুরুত্বকে যেসব বুদ্ধিমান মাথা বিচার, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষায় নিয়োজিত সেসব আসলে কি অবস্থায় তা করছে। সম্মোহিত হয়ে সেইসব বুদ্ধিমত্তা যে সেখানে কালক্ষেপণ করছে তাতে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। টু কিল টাইম ইজ টু শর্টেন লাইফ- কথাটা যদি সত্যি হয়, তবে তারা মৃত্যুর দিকে দ্রুত এগোচ্ছে। কোন মৃত্যু এটা? এন ইন্টেলেকচুয়াল ডেথ। ইঁদুররা পিনাট বাটারের সম্মোহনে পড়ে ফিজিক্যালি মারা যায়। তারা র-ইমোশনের সম্মোহনে পড়ে ইণ্টেলেকচুয়ালি মরছে। দুটোই কিন্তু মৃত্যু। ভাল ভাল যেসব লেখা পড়ার কথা ছিল তাদের তা অবলীলায় দৃষ্টির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। জানা ও বোঝার সময় পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুততার সাথে। সেইসব হাই-নরিশড লেখায় লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের সংখ্যা দেখে তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না।

নিচের ভিডিও ক্লিপটা ভালভাবে লক্ষ করুন। ইঁদুরগুলোকে কেউ বাধ্য করেনি রোলারের উপরে চড়তে। তাদের আত্মরক্ষার জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট রয়েছে। লোভের মতন একটা ফান্ডামেন্টাল ইমোশন তাদের বুদ্ধিমত্তাকে কাবু করে তাদের চড়িয়ে দিয়েছে আত্মঘাতি রোলারের উপরে। যে কোন উপায়ে রোলারের মাঝখানে লাগানো পিনাট বাটার খেতে হবে। খেতে গিয়ে মৃত্যুকুপে ধরাশায়ী বুদ্ধিমান ইঁদুরেরা। আমরাও অবিকল ঐ তেলাপোকা আর ইঁদুরদের মতন একই কাজ করছি। এই বাস্তবতা থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটাই পথ, নিজেদের জাতীয় বু্দ্ধিমত্তার গড় মানকে ইঁদুর ও তেলাপোকার স্তর থেকে আরেকটু উপরে নিয়ে আসা।

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s