নেতৃত্ব সংকটের বহুমুখী তমসা 


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

এখন পর্যন্ত দুনিয়ার হালচাল দেখে ধারণা জন্মে- মনুষ্য দক্ষতা, গুণাবলী, সক্ষমতার প্রায় পুরাটাই অপচয়। দেশ কাল ভেদে কিছু তারতম্য থাকলেও থাকতে পারে। তবে মোটা দাগে বলা যায়, মানুষের বহুমুখী অস্তিত্বের সবটা ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মূল কারণ হিসাবে ধরা যায়, মানুষ তার সঠিক পরিচয়, মূল্য, ক্ষমতার বিষয়ে প্রায় অন্ধকারে রয়ে গেছে। যদি সেটা সে জানতে পারতো তবে তার আচরণ যেত বদলে। পৃথিবীটা হতো অন্য রকম। অবশ্যই ইতিবাচক কিছু একটা হতো। তাকে যেমন অন্য কেউ মূল্য দেয় না, সে নিজেও পারে না তার মূল্য নির্ধারণ করতে। এই অবস্থাটাকে আত্মসম্মানবোধহীনতা বা ল্যক অফ সেলফ-এস্টিম বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্যে শৈশব থেকে সেলফ-এস্টিম কিভাবে বাড়ানো যায় তার জন্যে নানান সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস কার্যকর। এর ফলাফল তারা হাতেনাতে পাচ্ছে। তারপরেও মানুষ যেহেতু জন্মগতভাবে নেতিবাচকতা অন্তরে লালন করে, তাই এই বস্তুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তবে সেলফ-এস্টিম নামের মহার্ঘ প্রয়াসকে টিকে থাকতে হয়।

মানুষের অপচয় প্রসঙ্গে একটা চলচ্চিত্রের কথা মনে এলো। পরিচালক লাক বেসন ২০১৪ সালে লুসি নামে যে ফ্যণ্টাসি নির্ভর হলিউডি সাইফাই ছবিটা তৈরি করেছিলেন, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে এমন এক সত্যের। যে সত্যকে বাস্তবতার নিরিখে আমরা কোনভাবে লুকাতে পারি না। লুকানো যায় না। ছবিতে দেখা যায়, নায়িকা লুসির শরীরে জোর করে ঢুকানো হয় একটা বিশেষ মূল্যবান সিন্থেটিক ড্রাগ। এতে তার মস্তিষ্কের নিউরণ ব্যবহারের পরিমাণ বেশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্ঞানী মানুষটি আজতক তার মস্তিষ্কের শতকরা বিশ থেকে পঁচিশ ভাগ নিউরণ ব্যবহার করতে পেরেছে। কিন্তু সেই ড্রাগ ব্যবহারের পর থেকে মেয়েটা ষাট ভাগ নিউরণ ব্যবহার করে এমন সব কাজ করতে শুরু করে দিলো, যা সবার চোখে অলৌকিক। এরপর একসময় সে পুরা ড্রাগটাই নিজের দেহে ইঞ্জেকশন নিয়ে নেয় এবং সে তখন তার ব্রেইনের একশত ভাগ নিউরণ ব্যবহার করতে শুরু করে। আমরা ঈশ্বর বলতে যা বুঝি, সে তখন তাই হয়ে যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে সে তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

ফ্যণ্টাসি তো ফ্যণ্টাসিই। তবে যে সত্যটা লুসি চলচ্চিত্রে উঠে এলো, তা এক কথায় মানুষ ও তার অসীম সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার একটা বাস্তব ভিত্তিক অসীমতা রয়েছে। আমরা ও আমাদের আশেপাশের মানুষেরা সেটাকে সজ্ঞানে অস্বীকার করি। আমরা ভুলে যাই আমরা কি ও কেন। যদি রূপক হিসাবে চিন্তা করি, তবে ঐ ছবির সিন্থেটিক ড্রাগের সাথে তুলনা করা যায় আত্মসম্মান বা সেলফ-এস্টিমকে, যা বাড়িয়ে দিতে পারে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরণ ব্যবহারের পরিমাণ। যে কাজ কোন একজন মানুষ চাপে, ভাপে, তিরস্কারে করতে অপারগ, সে খুব সহজে আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে কাজটা করে ফেলে। এর অজস্র প্রমাণ আমরা দেশ কাল ভেদে সর্বদা পাই।

আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস একটা চর্চার বিষয়, একটা সংস্কৃতির বিষয়। ভালকিছু ঘটলে, ভালকিছু করলে কালক্ষেপণ না করে ধন্যবাদ-প্রশংসা জ্ঞাপন, একেবারে অপরাধের পর্যায়ে না পড়লে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে শুধরে দেয়ার সুকুমার কলা, সহনীয় মাত্রার বাঁকা কথা বা কাজকে ক্ষমা করার ধ্রুপদী সংস্কৃতি এককথায় সমাজে সেলফ-এস্টিম চর্চার পথকে প্রসারিত করে। প্রকারান্তরে সেলফ-এস্টিম বা অত্মসম্মান অন্তরে ঘুমন্ত আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলে আমাদের অনভ্যস্ত চোখের সামনে বিপুল সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। তখন সেটাকে অলৌকিক কিছু মনে হলেও হতে পারে। এই কারণেই হয়তো মহামতি সক্রেটিস বলেছিলেন- নো দাই-সেলফ, মানে নিজেকে চেনো আগে। মানুষের মধ্যে যে আত্মজ্ঞান বা নিজেকে চেনার বিরাট এক শূন্যতা রয়েছে, তা তিনি বুঝেছিলেন স্বউন্মোচিত চেতনা দিয়ে।

কোন অভ্যাস বা চর্চার কথা বলতে গেলে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে নিজের জাতির কথা, সম্প্রদায়ের কথা, ধর্মের কথা ইত্যাদি। এ পর্যন্ত বাঙালিই বাঙ্গালির সমালোচনা বা তিরস্কার করেছে সবচেয়ে বেশী, সবচেয়ে নগ্নভাবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, যতটা ক্ষয়িষ্ণু ভাবছি আমরা বাঙালি সমাজকে ততোটা হয়তো সে নয়। তার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার মনে হয়েছে নেতৃত্বের সংকটকে। তা সে পরিবার হোক, সমাজ হোক বা রাষ্ট্রই হোক, সবখানে এই অভাবটা দৃশ্যমান। কালের বিবর্তনে সেখানে কোন নেতাও আসে না, জাতিও নামতে থাকে দ্রুত রসাতলে। এই কারণে সেখানে একটা বিশুদ্ধ অভ্যাস বা চর্চার পরিবেশ জন্ম নেয় না। এই অবস্থাটা মোটের উপর ভয়াবহ বলা যায়। মানুষের ভিতরে সৃজনশীলতা, উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তাকে সভ্যতার মহাসড়কের ঠিকানায় নিয়ে যেতে যে সব উপকরণের দরকার, তার মধ্যে অন্যতম একটা উপাদান আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান চর্চার উন্মুক্ত পথ। এই পথের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার জন্যে যেসব নেতার সবিশেষ প্রয়োজন, তারা যদি জন্ম না নেয়, তাহলে কে টেনে উঠাবে লাইনচ্যুত বগি পুনরায় লাইনে?

অনেক প্রতিভাবান বাঙালির লেখা থেকে জানতে পারি- বাঙালি সমাজ কোনমতে প্রতিভাবান্ধব নয়। সে প্রতিভাকে লালন, পালন, রক্ষণ, সম্মান দান, পুরস্করণ করতে অসমর্থ। তাই তার অনেক প্রতিভা আঁতুড়ে মরে, কেউবা বিপথে যায়। আগেই বলে রাখা ভাল যে, প্রতিভার সঠিক সংজ্ঞায়নে আমাদের একটা বড় ভুল রয়ে গেছে। যে সক্ষমতা নতুন সৃষ্টিতে স্বতঃস্ফূর্ত ও মৌলিক তাইই প্রতিভা। তা না হলে সিলিকন চিপ সবচেয়ে বড় প্রতিভার আঁকর। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্র বা রবিগুরু কবিন্দ্র বিষয়ে অনেকে ক্ষোভের সাথে বলে থাকেন- একজন পিরালী বা ব্রাহ্ম্যধর্মী রবি ঠাকুর যদি হতদরিদ্রের ঘরে জন্ম নিয়ে বাঙালি সমাজে থেকে বড় বড় কথা বলে বা লিখে নোবেলজয়ী শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হতে চাইতেন, তবে তাকে হিন্দু সমাজের মার্সি কিলিংয়ের আওতায় গণপিটুনিতে মরতে হতো। কথাটা সত্য বলে মনে করি। তাঁর প্রতিভার পশ্চিমা স্বীকৃতি বাঙালিকে সেদিন উৎসাহ যুগিয়েছিল রবি-সম্বর্ধনায়। কিন্তু তিনি সেই অযাচিত আদর প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মিষ্ট প্রতিশোধে। রবি ঠাকুর এখন পর্যন্ত বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু তাকেও একসময় শুদ্ধিবাদী সমাজে একঘরে হয়ে কাল কাটাতে হয়েছিল। সমাজে একাকীত্বের মাঝখানে বসে তিনি সেটাকে ব্যবহার করেছিলেন আত্মআবিস্কারের সার্থক প্রয়াসের কাজে। শুদ্ধিবাদী কুলীন হিন্দু সমাজের উপরে তার তেমন বিশ্বাস ছিল না। অনেকে বলে থাকেন এই নিরাপত্তাবোধের জায়গা থেকে তার পাচক হিসাবে নিযুক্তি পেয়েছিল একজন মুসলমান প্রজা। নিঃসন্দেহে রবিঠাকুর বাঙালি সমাজের একজন অনন্যসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু এই প্রতিভা তার নিজ সমাজে ডালপালা বিস্তার করে স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে, নিজের একাকীত্ব দিয়ে নিজের ভিতরে গড়ে তুলেছিনেন সেই মহার্ঘ অনুকূল প্রতিবেশ। কতজন পারে বা পেরেছে এই কাজ করতে?

বাঙালির সমালোচনা আমার কোন প্রিয় বিষয় নয়। তবু মাঝেমাঝে মনের দুঃখে কাজটা করে ফেলি। প্রতিভাহীন ভুক্তভোগী হয়েও করি। আমি মনে করি, পানির ভিতরে বাস করে মাছ যেমন পানির ভালমন্দ বুঝতে পারে না। বাঙালিও হয়তো তেমনি বাঙলায় থেকে বাঙালির সমালোচনা ঠিক সেইভাবে করতে সমর্থ নয়। তবে বাঙালি তো মাছ নয়। সে প্রথমে মানুষ, পরে বাঙালি। যারা বাঙলার বাইরে থাকে, যারা একই সাথে ধাতস্থ করতে পেরেছে বাংলা ও বাংলাবহির্ভূত সংস্কৃতির মূল স্রোতধারা, তারা বোধ হয় বাঙালির সমালোচনা করলে কিছুটা অন্যরকম হবে। মূলকথা বাঙালিকে চিনতে গেলে, বুঝতে গেলে বাংলার বাইরের হাওয়া দেহে মনে সঞ্চারিত করতে হবে। ভালমন্দের তুলনাটা সার্থকভাবে করা যাবে তখনই। শুধু সমালোচনা করে ছেড়ে দিলে হবে না, কিভাবে লাইনচ্যুত বগিটাকে ধরে লাইনে পুনস্থাপন করা যায়, সেই উপায়ও বাতলাতে হবে। মূল সমস্যা বোধকরি সেখানেই, যেখানে রয়েছে আত্মসম্মান চর্চার অবারিত অভ্যাসের বিষয়। বাঙালির নেতৃত্ব সংকটের কারণে যে আত্মসম্মানবোধের প্রতিষ্ঠা ও চর্চা সম্ভব হচ্ছে না। সঠিক নেতার জন্ম না হলে তা সম্ভবও হবে না কোনকালে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s