লিখেছেন- রওশনারা বেগম
অতি ধনী কী ভাবে হচ্ছে? অতি ধনীর সংজ্ঞা কি? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাকে অর্থনীতির বিষয়ে কিছু জানতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ কী ভাবে অতি ধনী হচ্ছে সেটি পরে জানার চেষ্টা করবো। এর আগে জানতে চাই, কত টাকা হলে আপনি অতি ধনীর কাতারে পড়বেন। এক জায়গায় দেখতে পেলাম ২৫০ কোটি টাকার মালিক হলেই আপনি অতি ধনীর কাতারে। এটি ডলারে হিসাব করলে বের হবে কত মিলিয়ন। আমি ছোট যে হিসাবটি জানি তা দিয়েই বের করা যায়। কানাডিয়ান ১ মিলিয়ন ডলার মানে ৬কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ ২৫০ কোটি টাকা মানে ৩৯ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। সেই হিসাবে এটি সত্যি বিপুল পরিমাণ অর্থ যা অকল্পনীয়। এই সপ্তাহের লটো ম্যাক্সের পুরষ্কার ৫৫ মিলিয়ন ডলার। এই লটোর টিকেট মূল্য ৫ ডলার। এই কানাডাতে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন মিলিয়নিয়ার হচ্ছে লটারি জিতে। এখানে মানুষ মাত্র ১ মিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখে যা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র সাড়ে ৬ কোটি টাকা। একটা দরিদ্র দেশের মানুষ কী ভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। তবে কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি।
অনেকেই হয় তো জানেন এবারের কোরবানি ঈদে চামড়ার দাম ৫০% এরও নিচে নেমে গিয়েছিল। কেন এমন হল? বাজার দর কন্ট্রোল করার জন্য একটা বড় সিন্ডিকেট এর পিছনে কাজ করে। প্রকৃত উৎপাদন দাতার পেটে লাথি মেরে এরা বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সেই দরিদ্র কৃষকের, যে টাকা খরচ করে উৎপাদন করলো, সে আরও দরিদ্র হয়েগেল। তার আর কোন উপায় নেই। সে তো কাচামালের যোগানদাতা। এতে সব টাকা কার হাতে চলে গেল? চামড়া ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক যে সে হল এর বড় অংশের বেনিফিসিয়ারী। কারণ চামড়াজাত শিল্পের উইপাদিত পণ্যের দাম কিন্তু বাজারে একটুও কমেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুধু এই কুরবানি ঈদকে সামনে রেখেই অনেক ধনী শিল্পপতিরা অতি ধনী হয়েছে। আর গরীব কৃষকরা আরো গরীব হয়ে গেল।
মনে হয় বছর খানেক হবে বাজারে পিঁয়াজের দাম হঠাৎ করে ৮০-৯০% বেড়ে যায়। কেন এমন হয়েছিল? এর পিছনে কী কারণ? উৎপাদন কী কম ছিল? বাজারে পণ্যের দাম উঠা নামা করে সাপ্লাইয়ের উপর। এই যোগান দাতা কিন্তু যে উৎপাদন দাতা সে হতে পারছে না। এর মাঝে রয়েছে মধ্যস্বত্তভোগী। কৃষক কিন্তু পূর্বের দামে পিয়াজ বিক্রয় করেছে। সব লাভ পেলো কারবারিরা। এর মাধ্যমেও ধনীরা অতি ধনীতে পরিণত হলো, দরিদ্র অতি দরিদ্রে। এটি তো গেলে একটা জায়গা। আরো অনেক জায়গা আছে। বিশ্বের বাজারে তেলের দাম নেমে যায় কিন্তু দেখা যায় বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম কমানো তো দূরের কথা বরং কয়েক দফা বাড়ানো হয়। এতে নিরীহ ভোক্তার পকেট কাটা পড়ে । আর এই তেল ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা অতি ধনীর কাতারে চলে গেলে। এই ভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে অতি ধনী হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সাধারণ ভোক্তা এবং প্রকৃত উৎপাদক, যে সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত। যে দেশে আইনের শাসন নেই সেই দেশে এই ভাবে অতি ধনী হবার হারটি বেড়ে যায়।
আরও আছে, আরও আছে। ব্যাংকের থেকে বিশাল অংকের টাকা ধার নিয়ে শোধ না করার যে কালচার চালু হয়ে গেছে, তার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বহু দেশপ্রেমিক অতিধনীর কাতারে সগর্বে দাঁড়িয়ে গেছে। যে ক্ষমতা হাতে পায়ে কোমরে থাকলে ঋণগ্রস্থ্য হয়েও ব্যাংককে বলা যায়, টাকা পরে নিও, সেই ক্ষমতার একটা ফলিত চর্চার পরবেশ সৃষ্টি হয়েছে পুরা দেশ জুড়ে। তার সুযোগ নিয়ে ধনকুবের সেজে ফিনান্সিয়াল টাইমসে চোখ বড় বড় করে বিবৃতি দেয়ার একটা মোক্ষম সময় এসে গেছে হয়তো। এই সুযোগের গিট্টু সহজে হাতছাড়া করবে না কোন প্রভাবশালারা। যে দেশে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা চোর ডাকাতের মতন কথা কয়, আর পুলিশ-পেয়াদা হয়ে যায় হুকুম তালিমের দুপয়সার কালা জাহাঙ্গীর, সেখানে এর থেকে ভাল কিছুর আশা করা দুঃস্বপ্নের সামিল।
শাসক শ্রেনির মনোপলি প্রভাব প্রতিপত্তি সীমাহীন দুনীতির পিছনে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যে সরকার জনগণের সাথেই দুর্নীতি করে তারা তো অতি ধনীর কাতারে যাবেই। শেয়ার বাজার দুর্নীতি কি ভাবে হয়েছিল? এর পিছনে কারা ছিল? এখন কেউ যদি বলেন, বাংলাদেশ উন্নতির দিকে দ্রুত যাচ্ছে তাই এত ধনী হচ্ছে। এই কথাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? ১৬ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। আর এই বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সামান্য কিছু দামের হেরফের করতে পারলেই পকেটে চলে আসে শত শত কোটি টাকা। বিশ্বের সব দেশে তেলের দাম যখন একেবারেই তলানীতে গিয়ে পড়লো তখন বাংলাদেশের সরকার জনগণের কাছে তেল বেশি দামে বিক্রয় করেছে। এই বাড়তি হিসাব কোথায় যাচ্ছে তা তো জনগণের জানার অধিকার ছিল। সেটি কী হয়েছে? যে দেশের শাসক জনগণের হতে পারেনি সে দেশেই এই সব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। আর অতি ধনী হবার ঘটনাটি ঠিক একই ব্যাপার।