রাষ্ট্র ও আমাদের প্রাণীজ উত্তরাধিকার


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

মানুষের অনেক কিছু আছে, যা অন্য কোন প্রাণীর নেই। যার বেশী থাকে সে নত হয়, বিনয়ী হয়। কিন্তু মানুষ তা হতে অপারগ। কারণ তেমন হতে গেলে শ্রম দিতে হয়, মনন দিতে হয়। অধিকাংশ মানুষ তা দিতে পারে না, বা দিতে চায় না। অল্প বিনিয়োগে সে বেশী মুনাফা চায়। এই চাওয়াটা প্রাণীজ, তার জৈব উত্তরাধিকার। জৈব উত্তরাধিকার চর্চায় সে যতটা স্বতঃস্ফূর্ত, অন্য কিছুতে সে ততটা নয়। অথচ এই স্বতঃপ্রবৃত্তিই উন্নত সৃজনশীলতার একটা কাঁচামাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় ইতরবিশেষ প্রবৃত্তির চর্চায়। এই বিষয়ে আলোচনায় গিয়ে যদি বর্তমানের দিকে চোখ ফেরানো যায়, তবে দেখা যাবে, একজন দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তা যতখানি স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে তার অসৎ দক্ষতা ব্যবহার করে অর্থ উপায়ে নিমগ্ন হয়, ততোটা সে নিজের সুকুমার মনন চর্চায় নিয়োজিত হয় না। ওসবের কোন মূল্যই হয়তো তার কাছে নেই। আজকের দিনে আমাদের চেনাজানা সমাজে এমন মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে চলেছে।

কী আমাদের জৈব উত্তরাধিকার, অনেকের মতন আমারও তা জানার আগ্রহ প্রবল। মানুষ জাতি নামে সত্যেন বাবুর একটা বিশ্বখ্যাত কবিতা আছে। তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েই আমি ওই কবিতাটার নাম দিতে চাই প্রাণী জাতি। কারণ এই কবিতাটার পাঁচভাগের তিনভাগে এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা এই পৃথিবীর সকল প্রাণী একই ভাবে ভোগ, উপভোগ ও ভাগাভাগি করে। সেখানে বলা হয়েছে- আমরা সব প্রাণীকুল একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, একই সূর্য-চন্দ্র থেকে শক্তি পাই, শীত-তাপ-ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা একই ভাবে অনুভব করি, একই আবেগ, দায়, দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চা পালন করি, একই আদিম বাঁচার নেশায় যুদ্ধ করি, একই ভাবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি টান অনুভব করি, মৈথুনে লিপ্ত হই, পানিতে পড়ে বাঁচার আশায় সাঁতরে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করি। চামড়া কেটে গেলে ভেতর থেকে সবার একই লাল রক্তই বের হয়। শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর সব প্রাণীই প্রকৃতির দেয়া এইসব উপাদান, উপকরণ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকে। এইসব আমাদের কমন বা আম জৈব-উত্তরাধিকার। 

অনেক কিছু একই ভাবে অনুভব করার পরও আমরা কি প্রাণীদের উপরে সদয় হতে পেরেছি? এই প্রশ্নের উত্তর হবে- কিছুটা পেরেছি, কিছুটা পারিনি। কখনও পেরেছি। কখনও পারিনি। কেন পারিনি, সেই অনুসন্ধানে যাওয়ার আগে দেখে নেই, মানুষ হিসাবে আমাদের অতিরিক্ত কী আছে যা আমাদের ভাষায় ইতর প্রাণীদের মধ্যে নেই! আজকের সব প্রাণীর অস্তিত্বই গতিশীল সময়ের বিবর্তিত ফলাফল। এই বিবর্তনের রাস্তায় আমরা মানুষেরা অন্য প্রাণীদের চেয়ে দুটো জিনিস বেশী পেয়েছি- বিশেষায়িত বুদ্ধিমত্তা ও পছন্দের স্বাধীনতা (Specialized intelligence and freedom of options)। মানব অস্তিত্বের এক অংশের নাম সুপার ইগো বা বিবেক, যা যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করে। হায়ারার্চিকাল ট্রি বা জীবন-বৃক্ষ থেকে আমরা আরও পেয়েছি আমাদের আই ডি, পেয়েছি ইগো বা আরবীতে যাকে বলে নফসে আম্মারা। হোমো সেপিয়েন্সের উপরে অভূতপূর্ব দুই আশীর্বাদ স্থিত হবার পর তার জৈব উত্তরাধিকার কি তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে? এমন কোন কিছু ঘটবার সুযোগ নেই। আমরা তাহলে দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি- জৈব উত্তরাধিকার, বিশেষায়িত বুদ্ধিমত্তা ও পছন্দের স্বাধীনতার একটা সংমিশ্রণ বা কম্বো আজকের মানুষ। এই কম্বো ফ্রেঞ্চাইজ ম্যাকডোনাল্ডের জাংক হ্যামবার্গার কম্বোর চেয়ে কোন অংশে কম ক্ষতিকর নয়।

life

ম্যকডোনাল্ডের কম্বের ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব কিছু উপাদান এদিক ওদিক করে, ক্যলোরির ভারসাম্য এনে। কিন্তু মানুষ কম্বের সংশোধন কি সম্ভব? সম্ভব, তবে কাজটা ততো সহজ নয়। কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনেক সময় কুইনাইনের মতন কাজ করে। কুইনাইনে জ্বর সারায় কিন্তু কুইনাইন সারানো বেশ কঠিন ও শ্রমসাধ্য। মানুষের প্রাণীজ বৈশিষ্ট্য ও বুদ্ধিমত্তার মিশ্রণ থেকে চরিত্রগত ঝুঁকি দূরীভূত করতে হলে অনেক শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ দরকার। তা না হলে কোন হিউম্যান প্রজেক্ট থেকে আশানুরূপ মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। এমন কি পুরা বিনিয়োগ আম-ছালাসহ ব্যাংক্রাফট বা দেউলে হয়ে যেতে পারে। প্রাণীজ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মানুষের জন্যে যে ক্ষতিকর উপাদানটা রয়েছে, তার নাম সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের সমাজে বাস করে এই প্রবৃত্তির চর্চা কোনদিন ভাল ফল বয়ে আনেনি। এই প্রবৃত্তি বা নফসে আম্মারাকে মানবদেহ থেকে মুছে ফেলা যায় না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বশে আনা যায়। এই বশীকরণে ভাল ফল যেমন মানুষ আগে পেয়েছে, এখনও পাচ্ছে সভ্য জাতিগুলো। একটু বিবেচনায় নিয়ে দেখি, কী ঘটে যদি এই নফসে আম্মারার উপরে বিশেষায়িত বুদ্ধিমত্তাকে চাপিয়ে দেয়া যায়। অনেকে বলে, ভাল হতে পয়সা লাগে না। কথাটার ভিতরে মস্ত একটা ত্রুটি রয়ে গেছে। কথাটা হওয়া উচিৎ ছিল, খারাপ হতে পয়সা লাগে না, তেমনি শ্রমও লাগে না। কিন্তু ভাল হতে পয়সা লাগে। শ্রম ও মেধা দুইই লাগে। সিভিলাইজেশন ইজ এক্সপেন্সিভ- কথাটায় আমার বিশ্বাস আছে।

আমাদের প্রাণীজ উত্তরাধিকারের আওতাভুক্ত বৈশিষ্টসমূহ যদি বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত হয়, তবে মানব সমাজ বলে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। প্রলয় সেখানে অবধারিত, যে প্রলয়ের থেকে দেবালয় অথবা পতিতালয় কোন কিছু ছাড় পায় না। এমন ত্রিমাতৃক সমাজের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল, ইতিহাস ঘাটলে তার প্রমাণ মিলবে নিঃসন্দেহে। বিজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির কথা, সেটা ভয়ের ব্যাপার। তবে তা ফিরে ফিরে আসার জন্যে যে পারিপার্শ্বিকতার দরকার, তার অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও না কোথাও থাকা লাগে। এই পরিবেশ এই একবিংশ শতকে পৃথিবীর কোথাও কি দৃশ্যমান আছে? একটু অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে তাকালে এর অস্তিত্ব আমাদের চোখে ধরা দেবে। চেঙ্গিস, তৈমুর, হালাগু, হিটলার, মুসলিনীরা এমন পারিপার্শ্বিক আবহের সার্থক পালক ও প্রতিভূ। ইতিহাস থেমে থাকে না, বারবার ফিরে আসে। তাই ইতিহাসের খলনায়কদের হাত ধরে এখনও সমানে জন্ম নিয়ে চলেছে তাদের উত্তরাধিকারগণ। এই যুগের একনায়কেরা, জলপাইরাজেরা, ধর্মদস্যুরা, পুঁজিপতি সাম্রাজ্যবাদীরা সহজাত প্রবৃত্তি ও বুদ্ধিমত্তার মিশ্রণ চর্চার ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব। সর্বংসহা বসুমতী নিজ সন্তান জ্ঞানে এই ক্ষতিকর অস্তিত্বের নালন পালন করে থাকে। আমরাও কি করি না?

কী ঘটে যদি এর উল্টোটা হয়! যদি কর্মস্পৃহা, ইচ্ছা, বাসনা, স্বার্থ চালিত হয় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, যদি অনুপ্রাণিত হয় সুপার ইগো, বিবেক, বা অতিপুরাতন আরবীতে যাকে বলে নফসে লাওয়ামাহ, তাই দিয়ে, তাহলে কী ঘটতে পারে? যে বেহেশত মানুষ কল্পনা করে, যে কল্পিত স্বর্গকে মুলোর মতন নাকের ডগায় ঝুলিয়ে ধরে ভণ্ড বকধার্মিকেরা আল্লার নামে হাঁক দিয়ে হত্যার উৎসবে মাতে, তার থেকে উন্নত ও যৌক্তিক একটা বহুমাত্রিক স্বর্গ বাস্তবে নেমে আসতে পারে ধুলামলিন পৃথিবীতে। কিন্তু কিভাবে? এই কাজ বাস্তবায়িত করা ব্যক্তির থেকে সমষ্টির পক্ষে সহজ ও সাবলীল। এই কাজের নীলনকশা প্রণয়ন করতে হয় রাষ্ট্রকে। বিবেক বর্জিত রাষ্ট্রের হৃদয়ে এই স্বর্গের বাসনা লালন করা অসম্ভব।

সহজাত প্রবৃত্তি চালিত বুদ্ধিমত্তা এবং বিবেক চালিত বুদ্ধিমত্তা যে দুই ধরণের মানুষের জন্ম দেয় তাকে যথাক্রমে মিস্টার হাইড ও ডক্টর জেকিলের সাথে তুলনা করা চলে। এই দুই বিপরীতমুখী চারিত্রিক ধারা নিয়ে মানুষ খুব সামান্যই এগুতে পারে সভ্যতার যাত্রায়। ডক্টর জেকিলের সামনে বাড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে পিছনে টেনে ধরে মিস্টার হাইড। ডঃ জেকিলের পথ বাঁধা বন্ধনহীন করতে হলে দরকার সঠিক আইন ও তার সার্থক প্রয়োগ। আধুনিক সভ্যতার ঊষালগ্নে এই কথা কেমন করে জানি বুঝে ফেলেছিলেন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবস, যিনি একাধারে ম্যকিয়াভেলি, এরিস্টটাল ও প্লেটোর দ্বরা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিলেন। টমাস হবসের ‘ফেয়ার ইজ দ্য কি’ অপ্তবাক্যে বিশ্বাস রেখে বলতে হয়, প্রণীত আইন অন্ধকারের ভিতর থেকে ডঃ হাইডকে আলোতে নিয়ে আসতে পারবে তখনই যখন আইন প্রণয়ন করা হবে বদলোকদের বদ খাসলাতের কথা মাথায় রেখে। ভাল লোককে নিয়ন্ত্রণের জন্যে আইন নয়, মনে রাখতে হবে সেই কথাও। মিস্টার হবস মানুষের জন্মগত চারিত্রিক দোষসমূকে উপরে তুলে ধরে বলেছিলেন- মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর, অপরাধপ্রবন ও চতুর। তাকে শৃঙ্খলার ভিতরে আনার জন্যে সঠিক আইন আর তার যথার্থ প্রয়োগের কোন বিকল্প থাকতে পারে না। ১৬৫১ সালে তার রচিত গ্রন্থ লেভিয়াথানে সোশাল কন্ট্রাক্ট থিওরি রাজনীতির দর্শনে যে নতুন যুগের সূচনা করে, তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটা মাইল ফলক।

ইতর প্রাণীর সহজাত প্রবৃত্তি চালিত বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের সৃষ্টির নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত হবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আশরাফুল মখলুকাত অথবা আতরাফুল মখলুকাতের সনদ অন্য কোন প্রাণী মানুষকে দিতে আসেনি, সে নিজে নিজেকেই দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই সনদ প্রদানের কাজটা সম্ভব হলো, যেখানে মানুষ নিজেই নিজেকে জানে না, বুঝে না? সারা জীবনভর শ্রমে ঘর্মের প্রচেষ্টায়ও মানুষের পক্ষে সম্ভব না নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জানা। নো দাই-সেলফ বলে মহামতি সক্রেটিস মানুষের এই নিজেকে না জানার অজ্ঞতাকে প্রকাশ করে দিয়ে গেলেন সবার সামনে। এইভাবে নিজেকে না চিনে, নিজেকে আশরাফুল মখলুকাত উপাধিতে ভূষিত করা কি সুবিবেচনার কাজ হলো মানুষের জন্যে? একটা গরুর বাস্তবতা এবং মনোজগতের খবর কতটা মানুষ উদ্ধার করতে পেরেছে? একটা বেজি বা পিপড়ার সমাজ সংসারের খুঁটিনাটি? নিজের দক্ষতাকে, নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে নিজেরা সার্টিফাই করা মানুষের একটা নিরঙ্কুশ সহজাত প্রবৃত্তি।

তবে পথ আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক পশুত্বের হাত থেকে মুক্তির পথ আছে। সেই আলোকিত পথের নাম হতে পারে  আধ্যাত্মিকতা- একটা অপশান, একটা উপায়। সেটা কি ও কেন, সেইসব বিস্তারিতে যাবার আগে তার ভুল ও দুষিত সংজ্ঞায়নের বিষয়ে কিছু বলা জরুরী। সর্বসাধারণে আধ্যাত্মিকতা মানে মিরাকল, অলৌকিকতা, তিল থেকে তাল বানানোর ক্ষমতা, ডানা ছাড়া আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া, অন্যের মনের খবর জেনে ফেলা, উদাস, দেউলে ইত্যাদি। আধ্যাত্মিকতার অর্থ এগুলোর কিছুই না। আধ্যাত্মিকতা মানে আমি থেকে আমরা হয়ে উঠা। আমরা থেকে বিশ্ব হয়ে উঠা, মহাবিশ্ব হয়ে উঠা। ব্যক্তির স্বার্থ সমষ্টির স্বার্থ হয়ে যাওয়া। তোমাকে আমার ভাল লাগে না, তোমার শাসন আমার ভাল লাগে না। তার মানে এই নয় তোমার ঘরে আমাকে আগুন দিতে হবে অথবা তোমার পাকা ধানে আমার মই দিতে হবে। আমি স্রেফ তোমার বানানো কোন জিনিস ঘরে তুলবো না, তোমার কোন জিনিস আমি কিনবো না। এইই আমার প্রতিবাদ। এই অহিংস রাজনীতির পরীক্ষা দিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই সেই রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা। একজন লোক সারাটা জীবন গবেষণায় নেশাগ্রস্থ হয়ে কাটিয়ে শেষে কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেললো। সে ভাবলো- আমার এই আবিষ্কার সবাই যাতে সহজলভ্যতায় পেয়ে যায়, সেজন্য আমি পেটেন্ট করবো না। পৃথিবীর সব মানুষকে তার সেই আবিষ্কার সে উৎসর্গ করলো। এই বিজ্ঞানী আমি থেকে বিশ্ব হয়ে উঠার একটা দৃষ্টান্ত। সমাজ ও ব্যক্তিজীবনেও আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনী রয়েছে। সেসব কিছু চর্চা আর অভ্যাসের বিষয়। আধ্যাত্মিকতা তাই হস্তান্তরযোগ্য পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, পীর-ফকির, সাধু-কাপালিক কোন কিছুই নয়। এই সব ট্রেডমার্কের জন্ম হয়েছে অপবানিজ্য ও অপরাজনীতি কায়েমের উদ্দেশ্যে। অন্ধকারে বসে ক্ষমতা চর্চার অবৈধ অভিলাষ পূরণ করতে।   

সব খারাপের ভিতরে যেমন এক টুকরো ভালর দানা থেকে যায়, তেমনি সব নিরাশার ভিতরেও থেকে যেতে পারে আশার কিছু সম্ভাবনা। তাই হয়তো পরিপূর্ণ খারাপ হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। গ্যাসচেম্বারে মানুষ পাঠিয়ে হিটলারকেও কিছু সময়ের জন্যে আশ্রয় খুঁজতে হয় বেহালার করুণ রাগিণীর সম্মোহনে। চেঙ্গিস খানকে ফিরে যেতে হয় নর্তকীর নূপুর নিক্বণে। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা চালিত প্রাণীজ উত্তরাধিকারের ব্যবহার নিরঙ্কুশ ভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। সেখানে তার নিজেরই অজান্তে সরিষা পরিমাণ হলেও ঢুকে পড়ে যুক্তি, বিবেক, সুপার ইগো, ও বিবেচনা বোধ। এখানেই তার পশুশক্তির পরাজয়ের সূচনা। এইভাবেই সে নিজের ভিতরে তৈরি করে নেয় এক ধরণের বিপক্ষ শক্তি। ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয়ের জন্যে এটা সত্য। তারপরেও একটা মানুষের বা একদল মানুষের মানবিক অস্তিত্বের শতকরা নব্বই ভাগ বুদ্ধিমান পশুতে পরিণত হওয়ার প্রায় পুরোটা দায় রাষ্ট্রসহ অন্যান্য ক্ষমতায়ীত প্রতিষ্ঠানের। ব্যক্তি-মানুষের দায় সেখানে খুবই নগণ্য। একটা সচল রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক পশুত্বের চর্চা করে যায়, সেখানে ব্যক্তি-মানুষের মানবিক অবস্থানে স্থির হয়ে টিকে থাকাটা প্রায় অসম্ভব। তাই টমাস হবসের সেই সোশাল কণ্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তির সফল বাস্তবায়নই মানবিকতার সার্থক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পারে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s