লিখেছেন- শাখা নির্ভানা
কানের সাথে মাথার যে সম্পর্ক, কাল্টের সাথে ধর্মেরও তাই। কান টানলে অবধারিতভাবে মাথা চলে আসে। কাল্টের বিষয়ে কিছু বলতে গেলে তাই ধর্ম আসবেই। কাল্টকে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন, তবে যে বা যারা কাল্ট হয়েছিল বা এখনও টিকে আছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে কাল্টকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা হতে পারে। সব কাল্টকে ধর্ম বলা যায়, কিন্তু সব ধর্মকে কাল্ট বলা যায় না। কাল্টের উৎপত্তিটা হয় ধর্মকে আশ্রয় করে। আস্তে ধীরে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা আলাদা হয়ে যায়, চিহ্নিত হয়ে পড়ে কাল্ট হিসাবে। চেষ্টা করবো কাল্টের সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূকে আলোতে নিয়ে আসতে এবং বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এর টিকে থাকার, ও সৃষ্টির সম্ভাবনাই বা কতটা সেটাও চেষ্টা করবো উন্মোচিত করার।
সমাজের একদল লোক যখন তাদের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে একীভূত হয় এবং তারা যদি একক ব্যক্তিত্ব, গন্তব্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর এক যাত্রায় সবাই অনড় ও কট্টর অবস্থানে থাকে, তখন তাদের কাল্ট হিসাবে অভিহিত করা যেতে পারে। লোক-সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েই কাল্টের সংজ্ঞা নিরূপণে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকে। তাই কাল্টের বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা মিথাশ্রয়ী হতে বাধ্য। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কাল্ট হচ্ছে সমাজ থেকে খসে পড়া একটা অংশ, যারা অনুশীলন করে তাদের নিজস্ব আদর্শিক আচার। এদের অনুসরণকারী সদস্যের সংখ্যা দুই-এক শত থেকে কয়েক মিলিয়নও হতে পারে। এমন কি তারা আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিতও হতে পারে।
১৯৩০ সাল থেকে পশ্চিমে ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গ হিসাবে কাল্টকে সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪০ সাল থেকে খ্রিস্টান কাল্ট বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে কিছু কিছু কাল্ট সম্প্রদায়কে প্রতিহত করা শুরু হয় এবং তাদের কর্মকাণ্ড যে মূল খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী তা সামাজিকভাবে প্রচার করা হয়। ১৯৭০ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী কাল্ট-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে, যা পরবর্তীতে বেশ বিতর্কের মধ্যে পড়ে তাদের কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে। আঠারো শতকের দিকে ‘নতুন ধর্মীয় আন্দোলন’ নামে যে বিশেষ জাগরণ পশ্চিমে শুরু হয়েছিল, তাদের ভিতরে অনেকগুলো দল কাল্ট হয়ে যায়। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে কাল্ট সম্প্রদায়কে কয়েকটা শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়- মহাপ্রলয় নির্ভর কাল্ট, একক ব্যক্তিত্ব পূজারী কাল্ট, রাজনৈতিক কাল্ট, ধ্বংসাশ্রয়ী কাল্ট, সাম্প্রদায়িক কাল্ট, বহুগামীক কাল্ট, এবং জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কাল্ট। এই শ্রেণীবিভাগ অনুসারে একটা শ্রেণীর ভিতরে যেমন একাধিক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, তেমনি একটা শ্রেণীতে একক মৌলিক বৈশিষ্ট্যও থাকতে পারে।
ধ্বংসাশ্রয়ী বা ডেসট্রাকটিভ কাল্ট কারা? যারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজেরদের দলের ভিতরের বা দলের বাইরের যে কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত বা হত্যা করতে দ্বিধা করে না। যারা নিজেদের জন্যে নির্ধারিত আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে দলের সদস্য বা কর্মীদের দৈহিক অথবা মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে কসুর করে না। এই কাল্টের কার্যকলাপ আবর্তিত হয় সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বা টোটালিটেরিয়ান পদ্ধতির শাসনের মাধ্যমে এবং অর্থ উপায়ের কার্যকরী আধিপত্যবাদের চারদিকে। অন্যসব কাল্টের মতন এই প্রজাতির কাল্টের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে একক ব্যক্তি এবং একক লিখিত বা অলিখিত বিধিবিধানের মধ্যে। কাল্ট নেতা বা নেতাগণের দ্বারা সকল সদস্যদের স্বভাব ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে যায়, ব্যক্তিগত পরিচিতির বিলোপ ঘটে, যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তাগত সকল চর্চা বন্ধ করে দেয়া হয়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সমাজ সম্পর্কে অরুচি তৈরি করা হয়, শাব্দিক অর্থে মনের উপরে নেতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরিপূর্ণ দাসত্ব দখল নেয় সদস্যদের জীবনের উপর।
প্রসিদ্ধ মনোবিজ্ঞানী পিটার এ ওলসন তার বহুল বিক্রিত, Jihad and Sacred Vengeance: Psychological Undercurrents of History বইয়ে লিখেছেন- জিম জোন্স, ডেভিড কোরেশ, সোকো আশাহারা, মার্শাল এপেলহোয়াইট, লাক জারেট, ও জোসেফ ডি মামব্রো প্রভৃতি টেররিস্ট কাল্টদের মতন ওসামা বিন লাদেনও একজন টেররিস্ট কাল্ট। তিনি আরও বলছেন নার্সিস্টিক পারসোনালিটি ডিসওর্ডার যে নয়টা কারণের জন্যে হয়ে থাকে এই সন্ত্রাসী কাল্টদের মধ্যে তার আটটাই পাওয়া যাবে। এইসব বিষয় নিয়ে যারা বিশ্লেষণধর্মী বই লেখেন, তাদের মধ্যে গোল্ডবার্গ এবং ক্রেসপোর নাম প্রণিধানযোগ্য। সম্মিলিতভাবে লেখা এই দুই লেখকের, Seeking the Compassionate Life: The Moral Crisis for Psychotherapy and Society বইয়ে উভয়ে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ওসামা বিন লাদেন একজন টেররিস্ট কাল্ট। দ্য টাইমসের সাংবাদিক ম্যরি এন আল কায়দার উপরে লেখা তার এক নিবন্ধে বলেন- আল কায়দা একটা ধ্রুপদী সন্ত্রাসী কাল্ট। এই দল অপরাপর টেররিস্ট কাল্টদের মতন তার সদস্যদেরও মন্ত্রায়ীত বা ইনডকট্রিনেট করে, বদ্ধ ও সার্বিক নিয়ন্ত্রিত বা টোটালটেরিয়ান একটা সমাজ গঠন করে, সদস্যরা স্বনিয়োজিত হয়, কারিশমেটিক লিডার থাকে তাদের, এবং তারা বিশ্বাস করে শেষ ফলাফলের ভিতরেই ন্যায্যতা নিহিত।
এবার একজন কাল্ট, ডেভিড কোরেশের বিষয়ে কিছু আলোকপাত করে ফিরে যাবো কাল্ট উৎপত্তির কারণ ও প্রতিকার বিষয়ক মূল আলোচনায়। ডেভিড কোরেশ, জন্ম ১৯৫৯ সালে আমেরিকার টেক্সাসে। ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান শাখার কাল্ট নেতা। তিনি নিজেকে শেষ নবী বলে বিশ্বাস করতেন। কোরেশের জন্ম হয় অকার্যকর এক পরিবারে। টেক্সাসের ওয়াকোতে ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান কাল্টের একজন পেটি নেতা হিসাবে যোগ দিয়ে একসময় মূল নেতায় পরিণত হয় কোরেশ। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ গঠিত হয়। অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুত করা, ড্রাগ ব্যবহার ও ট্রাফিকিং, বহুবিবাহ, ধর্ষণ ইত্যাদি অভিযোগে এ এফ টি, অর্থাৎ ইউ এস ব্যুরো অফ এলকাহোল, টবাকো এন্ড ফায়ার আর্মস সার্চ ওয়ারেন্ট বের করে। যার ভিত্তিতে ১৯৯৩ সালে ঐ কেন্দ্রে এফবিয়াই ও সিআইএর সহায়তায় ঐতিহাসিক সশস্ত্র অপারেশন সংঘটিত হয়। কোরেশ ডেভিডিয়ান চার্চে সার্চ করতে বাঁধা দেয়ায় দুইমাস পুলিশ ঘিরে রাখে কেন্দ্রটি। দুইঘণ্টার এক বন্দুক যুদ্ধে চারজন এএফটি এজেন্ট ও ছয়জন ডেভিডিয়ান মারা যায়। দুইমাস অবরোধের পর এফবিয়াই কেন্দ্রটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোরেশসহ ঊনআশি জন ডেভিডিয়ানকে মৃত পাওয়া যায়। সম্ভবত: সেক্ট ডেভিডিয়ানের সদস্যরা বিষ খয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আমাদের উপমহাদেশের এইকালের বাবা রাম রহিম এবং দু-তিন দশক আগের ভগবান রজনিশের কথা ও কাহিনী কে না জানে। সব ধর্মের আশ্রয়েই তারা বেড়ে ওঠে, ছড়িয়ে পড়ে চারদিক।
উপরের নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে বুঝা যায়, পশ্চিমের মানুষ কাল্টদের ক্ষতিকর অবস্থানের ব্যাপারে কতটা সচেতন। আমরা দেখেছি, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে তুলেছে কাল্ট বিরোধী আন্দোলন বা এণ্টিকাল্ট মুভমেন্ট, সেও তাদের সেই সচেতনতারই বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হওয়াতে তাদের সরকারেও জনসাধারণের মতামতের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা পায় দ্বিধাহীনভাবে। ডেভিড কোরেশের ব্যাপারে সরকারী সিদ্ধান্ত তাইই প্রমাণ করেছিল। এর পাশাপাশি যদি আমরা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশসমূহ, বিশেষ করে বাংলাদেশের দিকে একবার তাকাই তাহলে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোন আবেগ কাজ করবে বলে মনে হয় না। কারণ সেখানে সরকারী ও বেসরকারি কোন পর্যায়েই এই কাল্টদের নিয়ে কোন গবেষণা, বিশ্লেষণ, তদন্ত, অনুসন্ধান আছে বলে মনে হয় না। দেওয়ানবাগী, সায়েদাবাদী, হাঠহাজারী, চরমোনাই, আটরশী, এরা কারা, কি এবং কেন, সেইসব বিষয়ে কোন তথ্যভাণ্ডার সরকারী প্রশাসনের কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতে ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিগত দিক দিয়ে আমরা অদৃষ্টবাদী, অলৌকিকতাপ্রেমী, গড়পড়তা কুসংস্কারে ডুবে থাকা একটা পশ্চাৎপদ জাতি। তার উপরে গোদের উপরে বিষফোড়ার মতন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে নানান জাতের কাল্ট ও তাদের সহযোগী শ্রেণি। এইসব মিলেমিশে এমন এক কিম্ভুতকিমাকার সামাজিক রসায়ন তৈরি হয়েছে, যাতে সামনে এগুবার সব পথ বন্ধ হবার উপক্রম।
প্রশ্ন হতে পারে, কেন মানুষ কাল্ট হয়, কেন দলে দলে জড় হয় কাল্ট গুরুর আস্তিনের নীচে? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন কোন সন্দেহ নেই। শুরুতেই বলেছিলাম, ধর্ম কাল্ট তৈরির মূল অনুপ্রেরণা দাতা। কথাটা আংশিক সত্য, কিছু ভুল রয়ে গেছে। উপকরণগত দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে সামাজিক অবিচার ও বঞ্চনা, সার্বিক আধিপত্যস্পৃহা, বা স্রেফ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে নিধার্মীক মানুষও কাল্টে পরিণত হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ধর্মের জোব্বাটা পরেই আসে। এতে অনেক কিছু ঝুট ঝামেলা থেকে রেয়াত মেলে। সামাজিক সন্দেহের তীরসমুহ মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এই কারণে ধর্মীয় আবহের বাইরে তাদের দেখা মেলে কদাচিৎ। সাধারণের বাইরে যা, সংজ্ঞাগত দিক দিয়ে তাকে অসাধারণ বলা হলেও, সব অসাধারণ কল্যাণময় নয়, কিছু কিছু আত্মবিনাশীও বটে। কাল্ট তেমনই এক অসাধারণ আঙ্গিকের জীবন যার বিষ-দংশন গোটা মানব সমাজকে ভোগায় স্থান-কাল ভেদে সবাইকে।
কাল্টের বাংলা পরিভাষা কি হবে জানা বেশ মুশকিল, কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতিতে কাল্টের অস্তিত্ব দিবালোকের মত প্রকাশিত। কখনও ওলি, কখনও আউলিয়া, সাধু, কাপালিক, ইত্যাদি নামে তারা আছে। সবার একটা গন্তব্য আছে। গন্তব্যহীন যাত্রা মানুষ সহ্য করতে পারে না। ধার্মিকের গন্তব্য স্বর্গ। কাল্টের গন্তব্যও আছে এবং তা নির্ধারিত হয় তাদের সর্বোচ্চ নেতা দ্বারা। যে গন্তব্যই থাক, সেটা যে অনড় ধ্রুব তাতে কোন সন্দেহ নেই। নেতাকে ও তার অনুসারীদের সেই ঠিকানায় যে কোন মূল্যে পৌছাতে হবে। যে কোন মূল্যে মানে সত্যি সত্যি যে কোন মূল্যে। অপরাধের সব ধারণা সেখানে ভেঙ্গে পড়ে। দৃশ্যমান ও লোক-অন্তরালের সব অন্যায়, অপরাধ, পাপ পবিত্র গন্তব্যের সাপেক্ষে পবিত্র ও অত্যাবশ্যকীয় কর্ম হিসাবে বিবেচিত হয়। জীবন ও তার বহুমুখী বিন্যাস হয়ে পড়ে অতি গৌণ একটা বিষয়। এসব কিছু পালিত হয়, লালিত হয় নেতার লিখিত অথবা অলিখিত সংবিধানের ইশারায়। কাল্টের গন্তব্য যদি বাস্তব, পরাবাস্তব, আধ্যাত্মিক না হয়ে নেতার ব্যক্তিগত সুখ হয়, তাহলেও একই ভাবে অনুসারীগণ তা পরিতৃপ্ত করতে কাজ করে যাবে। ঠিক এই কারণে বলা হয়ে থাকে, ন্যুনতম জীবনকে সবার আগে জায়গা দিতে পারে না যে মতবাদ, তা ধর্ম নয়, অন্য কিছু, হয়তো কাল্ট।
বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক দিয়ে যখন কোন দল অতিবাম বা অতিডানের দিকে চলে যায়, তখন তাকে রাজনৈতিক কাল্ট বলা যেতে পারে। অতিডান বা অতিবাম অবস্থানে জীবন গৌণ হয়ে পড়ে। গন্তব্য ও আদর্শ বড় হয়ে দেখা দেয়। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশ জামাত ইসলামী একটা রাজনৈতিক কাল্ট। ‘কুকুর বিড়াল মেরো না, নাস্তিক পেলে ছেড়ো না’- এই প্রকৃতির আদর্শ ও শ্লোগান নির্ভর দলও ধর্মীয়-রাজনৈতিক কাল্ট। ‘বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস’- এই আদর্শেও যারা বিশ্বাস রাখে তারাও রাজনৈতিক কাল্ট শ্রেণীর অন্তর্গত। রাজনৈতিক কাল্টের প্রভাব সমাজ মনস্তত্ত্বের উপরে গভীর ও স্থায়ীভাবে যে দাগ ফেলে তার থেকে প্রত্যাবর্তন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
প্রতিথযশা মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা নার্সিস্টিক পারসোনালিটি ডিসওয়ার্ডার কাল্ট তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখে। কি সেই মনোবৈকল্য বা ডিসওয়ার্ডার, যা এতবড় এক বিপর্যয় তৈরি করতে সক্ষম? একজন মানুষ যেমন মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারে পৃথিবীতে আমিই শ্রেষ্ঠ মানব, আমার জন্যেই সব সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে একটা সম্প্রদায়ও বিশ্বাস করতে পারে আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, আমরা শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়। নার্সিসিজম এখানে এসে থেমে থাকলেও চলতো। তা না হয়ে তারা আরও দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে, অন্য কোন সম্প্রদায়ের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। অন্যের অধিকার ও জীবনকে স্বীকৃতি দিতে তারা অপারগ হয়। এটাই নার্সিসিজমের চরম ও শেষ অবস্থা। জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার এমনই এক দুরারোগ্য মনোবৈকল্যের প্রভাবে পৃথিবীতে বিপর্যয় এনেছিল বলে ধারণা করা হয়। আর কোন দল, সম্প্রদায়, নেতা, জাতি কি এই বৈকল্যকে আদর্শ হিসাবে মেনে নিয়ে পৃথিবীতে টিকে আছে? এটা জানতে পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও গবেষণার কোন বিকল্প আছে বলে মনে করি না।
মানুষের মানসিক অবকাঠামো তৈরিতে মিথের অবদান মনোবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই মিথ যদি মানব মনের উপরে প্রয়োগ নাও করা হয়, তবে সে তা তার নিজের প্রয়োজনে তৈরি করে নেয়। এখানেই মিথের যাদু। সব ধর্মই মিথাশ্রয়ী। মিথের ক্ষতিকর অংশের দিক থেকে বাঁচতে হলে, তার সীমারেখা টানতে হবে। এই সীমা টানাটানির ব্যাপারটা সামলাতে হয় রাষ্ট্রকে। ব্যক্তির পক্ষে সমাজের উপরে প্রভাব বিস্তার করা কঠিন। ধর্মের মতন কাল্টেরও জন্ম, বেড়ে উঠা ও বংশবিস্তার মিথের আশ্রয়ে থেকে। মিথ ধর্মের মত কাল্টেরও জননী। কাল্টের জন্ম ও বিস্তার রোধে গণসচেতনতার খুবই দরকার। আর এই সচেতনতাকে পুষ্টি যোগাবে শাসক ও প্রতিপালক। সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে নিরলস পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও গবেষণার ভিতর দিয়ে কাল্ট বিশ্বাস, ধারণা, ও চর্চাকে চিহ্নিত করে সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলতে না পারলে দিন শেষে তা গোটা জাতির ভাগ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে কোন সন্দেহ নেই তাতে।
তথ্যসূত্র- অনলাইন রিসোর্সসমূহ, উইকিপেডিয়া ইত্যাদি।