মোজেজা


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

মরহুম কাজী তালেব আলী সাহেবের দুইছেলে। একজন দ্বীনের আলেম, আল্লার ওলি- বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন তরিকার খিলাফত। আরেকজন বেদ্বীন, দেশ-গ্রাম, সব ছেড়েকুটে আমরিকায় নোঙর ফেলেছে। সেখানে ছেলে-মেয়ে পরিবার নিয়ে থাকে। ডাহাপূর গ্রামের সবাই জানতো তালেব হুজুর মাদারজাদ ওলী ছিলেন। সারা গাঁয়ে চাউর ছিল- তার রেখে যাওয়া গাধাটা একটা জিন, যার পিঠে তিনি সওয়ার হতেন। তিনি তার দুই ছেলে, মারুফুল আর শারুখুল, কারও জন্যে তেমন সহায় সম্পদ রেখে জাননি। তবে প্রচুর মুরিদান আর সন্মান-ইজ্জত রেখে গেছেন। দান-ধ্যানের হাত ছিল বড় হুজুরের। সেই পথে বেরিয়ে গেছে সব। তার ধারণা ছিল, এত পয়সা-কড়ি হাতে পড়লে ছেলেরা উচ্ছন্নে যাবে, তাই ব্যাংকেও তেমন জমা রাখেননি। কিন্তু ছেলেদের দ্বীন-দুনিয়ার শিক্ষা দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি হুজুর। মারুফুলকে পাড়িয়েছেন আরবী লাইনে, আর শারুখুলকে পাঠিয়েছেন ইংরেজী লাইনে। একজন পড়ে গেলে যেন আরেকজন টেনে তুলতে পারে। বড় হুজুর বুদ্ধিমান ছিলেন।

গাঁয়ের নিন্দুকেরা বলতো, বড়হুজুর তার বড় ছেলেটাকে কেন খয়রাতী লাইনে দিলেন। কথাগুলো হুজুরের কানে এলেও করার কিচ্ছু ছিল না, মুষড়ে পড়া ছাড়া। কারণ তাদের কথাগুলো সত্য। হয়েছিলও তাই। বড় হুজুর ইন্তেকালের পর দুইছেলে কর্মক্ষেত্রে ঢোকার সময় বুঝতে শুরু করলো, নিন্দুকদের কথা কতখানি সত্য। ছোট ছেলে শারুখুল তরতর কর পাশ দিয়ে আমেরিকা চলে গেল। বড়ছেলে পড়লো খয়রাতী চক্করে। বিয়ে, খতনা, জানাজা, মিলাদ, ঈমামতি, আর পীরগিরি করে কি সেইভাবে দিন চলে? চলে না। বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের মধ্যে অর্থ আর বিদ্যার ব্যবধান হয়ে গেল পাহাড় সমান। সেইমতে আরও দূরে থাকার কারণে সম্পর্কও দিনদিন হালকা হতে থাকলো। তবে বড়ভাইয়ের ছেলেটার সাথে ছোটকাকার মহব্বত বেশ অটুট। একটা সন্তান বাৎসল্য কাজ করে কাকা-ভাতিজার মধ্য। ছেলেটাকে আমেরিকা আনার ইচ্ছে কাকা শারুখুলের। মারুফুল ছেলেকে দ্বীনের আলেম বানাবে, সে নিয়ত করেছে, কোন নড়চড় নেই তাতে। এই নিয়ে দুইভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরলেও কাকা-ভাতিজার মহব্বতে কোন টোকা পড়ে না।

সেই বড়হুজুরও নেই, সেই জমজমাট পীরগিরিও নেই। সবকিছুতে ভাটা পড়েছে। ভাটার টানে এইভাবে কোন রকমে দিনগুজরান করছিল গদ্দিনশীন খয়িষ্ণু পীর মারুফুল। হঠাত একদিন সবকিছু কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। একেই বলে ভাগ্য। কাঁছা খুলতে দেরী হতে পারে, কিন্তু কপাল খুলতে দেরী হয় না। ভাইপোর জন্যে শারুখুল প্রায়ই নানান ধরণের খেলনা, বই, ইত্যাদির পার্শেল পাঠায়। একদিন একটা পার্শেল এলো আমেরিকা থেকে, আকারে আগের সবগুলোর থেকে বড়। খাদেম দিদার তার ছোটহুজুর মারুফুলের সামনে রাখলো পার্শেলটা। হুজুর হুকুম দিলেন- খোল বাক্সটা।

ভর দুপুর। আশেপাশে কেউ নেই। গদিতে পীর একা, সঙ্গে খাদেম। কার্টুনটা খোলা হলো। সেখান থেকে একটা বয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া বেরিয়ে এলো। মাথাটাও বেশ বড়। তবে আসল নয়, সিন্থেটিক। ভাইপোর বাঘ-বাঘ খেলার জন্যে পাঠিয়েছে কাকা। কয়েক মিনিট চুপ হয়ে রইলো ছোট হুজুর, খাদেমও। ছোট হুজুরের চোখে স্বপ্ন, একটা পরিকল্পনা, একটা বিরাট কোন বিস্ফোরণ।

-এই পার্শেলের কথা কাউরে বলা যাবে না দিদার।

হুজুরের চাপা কণ্ঠে উত্তেজনা। ইশারায় দিদারকে আরো কাছে ডেকে কানেকানে কী জানি ফিসফিসিয়ে বললেন ছোটহুজুর। কথা শুনে দিদারের চক্ষু বিস্ফোরিত। হয়তো আগামীর কোন অদ্ভুত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকার উত্তেজনায় তার চোখ ছানাবড়া।

পৃথিবীতে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। সবকিছুর কার্যকারণ মানুষ জানে না। যেগুলোর কারণ জানে, সেগুলো আর অলৌকিক থাকে না, হয়ে যায় লৌকিক, আটপৌরে। সেসবের দাম মানুষ দেয় না, দাম দেয় অলৌকিকের। সেই রকমই একটা ঘটনা ঘটলো ছোটহুজুরের জীবনে। বলা যায়, তিনি নিজেই ঘটালেন সেই ঘটনা। সেদিনটা ছিল জুমার আগের রাত। ফজরের আজানের তখনও ঘণ্টাদুই বাকী। ঘুম থেকে উঠে পাকসাফ হয়ে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়লেন হুজুর। অনেক কান্নাকাটি করলেন আল্লার দরবারে। ভাল লেবাস পরে, গায়ে আতর মেখে বাইরে এলেন। গেলেন আস্তাবলে। আস্তাবলে ঘোড়া নেই, আছে একটা গাধা। বাপের রেখে যাওয়া জৌলুশের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। মাঝে মাঝে চড়েন সেটায় ছোট হুজুর। পীর-অন্তপ্রান দিদার সেটাকে পীরের মর্জিমাফিক রেডি করে রেখেছে। কেউ দেখে বলবেনা এটা গাধা, সবাই বলবে এটা একটা মানুষখোর বাঘ। বাঘের পিঠে সওয়ার হলেন ছোট হুজুর মারুফুল। পূব আকাশ বেশ খানিকটা সাদাটে হয়ে উঠেছে। বসন্তের ভোর, হালকা ঠাণ্ডা থাকলেও কুয়াশা নেই। ডাহাপূর থেকে সামান্য একটু দক্ষিনে গেলে পীরালীগাঁও। সেই গাঁয়ের মসজিদের ঈমাম বেশ ভাল মানুষ, নিরীহ, সাদাসিধে বান্দা। ফজরের আজানের আগে, সবার আগে তাকে সেই মসজিদে আসতে হয় নামাজ পড়াতে। সেই মসজিদের দিকে মুখ করে বাঘের পিঠে সওয়ার হলেন ছোটহুজুর। মসজিদে আসার রাস্তাটা বেশ সরু, একটু জংলাও। রাস্তায় কোন লাইটপোস্ট নেই, তবে আশেপাশে দুই-একটা একতলা বাড়ি উঠছে। বাড়ির সামনে দুয়েকটা টিমটিমে বিজলীবাতিও বসানো হয়েছে। তার আলোতে রাস্তা চলে মুসল্লিরা, একে অপরের চেহারা চিনে সালামও দেয়। সেই রাস্তায় চলতে চলতে ঈমাম সাহেবের সাথে ছোট হুজুরের দেখা। ঈমাম সাহেবের মুখ দিয়ে খেলনা পুতুলের মতন টানা হালকা একটা শব্দে বেরিয়ে এলো- সালামালাইকুম ছোটহুজুর। কি জানি কী হয়ে গেল তার মাথার ভিতরে। কয়েক সেকেণ্ড পাথরের থাম্বার মত দাড়িয়ে থেকে গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে উচ্চস্বরে আল্লাহুয়াকবার বলতে বলতে মসজিদে দৌড়ে এসে পড়ে গেলেন তিনি। ছোটহুজুরের কোন দিকে নজর নেই, খেয়ালও নেই। তিনি চলছেন তার মতন বাঘের পিঠে করে। কিছুক্ষণ পরে ঐ রাস্তায় দেখা হলো মুয়াজ্জিনের সাথে। সেও ঈমাম সাহেবের মতন সালাম দিয়ে দৌড়ে পালালো।

হিসাবের গরু কোনদিন বাঘে মারতে পারে না। নিরেট পরিকল্পনা কোনদিন ভেস্তেও যায় না। ছোটহুজুরের পরিকল্পনাও ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল তার মেধার জোরে। ছোটহুজুর যখন নিজের বাড়ির সদর দরজায় এসে পৌঁছলেন, তখন ফজরের আজান পড়লো। আজনের করুন মোলায়েম ধ্বনি তাকে কিছু সময়ের জন্যে আনমনা করে দিলো। তার নিজের যে মসজিদ আছে সেখানেও তার আজকে নামাজ পড়ানো হবে না। মুয়াজ্জিন চালিয়ে নেবে।

-হুজুর।

গেটের পাশে অপেক্ষমান খাদেম দিদারের গলার আওয়াজ শুনে একটুখানি চমকালেন যেন ছোটহুজুর।

-ধর, গাধাটার গায়ের থন বাঘের চামড়াটা খুলে এহনই পুড়াই ফেল। দেরী করিস না।

হুজুরের আদেশে গাধা নিয়ে দিদার আস্তাবলে চলে গেলো।

সেই সকাল সাতটা থেকে একপাল মানুষ ছোটহুজুরের বাড়ির গেটের সামনে এসে জড়ো হয়েছে। তাদের সবার মাথায় টুপি। দিদার যত বলছে, হুজুর ঘুমাচ্ছেন, দেখা হবে না, ততো তাদের জিদ চেপে যাচ্ছে। তারা দেখা করে যাবেই। বাইরে বেশ একটু শোরগোল। এর ভিতর কি ঘুমানো যায়? একটা কালো চাঁদরে সারা শরীর ঢেকে ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ালেন ছোট হুজুর। সাথেসাথে বানের জলের মতন লোকগুলো হুড়মুড় করে ছোটহুজুরের পায়ে এসে পড়লো। পায়ের ধুলো নিলো, দোয়া নিলো তারা। কালো চাঁদর দিয়ে হুজুরের মাথায় একটুখানি ঘুমটা টানা। ঘুমটাটা একটু সরিয়ে কেমন নির্লিপ্তভাবে তিনি বললেন- তুমরা আমারে এট্টু ঘুমোতি দেও। এই কথা শুনে পিপড়ের সারির মতন লোকগুলো সুড়সুড় করে যে যার কাজে চলে গেল। তারা কি যেন বলতে এসেছিল, বলতে পারলো না।

এই ঘটনার পরে আর কখনও ছোটহুজুরকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আলাদীনের প্রদীপে ঘসা পড়েছে, আর বদলে গেছে তার চারদিক। নাম-জশ-অর্থ সব হয়েছে তার। এরই মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেছে প্রায় একটা যুগ। দুনিয়া, জিন্দেগানির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই ডাহাপূর গ্রামও আর গ্রাম নেই, হয়েছে নব্য শহর। তার চারদিকে এখন শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষের আনাগোনা। ছোটহুজুরের একটা ওয়াজ শুনতে এখন লাখো মানুষের ঢল নামে। সেই মান্ধাতা আমলের বক্তৃতা নয়, কোরান-হাদীস-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মিশিয়ে কথা বলার জ্ঞান সে হাতে পেয়ে গেছে। মূলধারার রাজনীতিও তাকে ছাড়া হয় না এখন। কেমনে হবে? ভক্তেরা তার জন্যে এখন জান দিয়ে দেয়। খয়রাতি চক্করে পড়ে ভিরমী খাওয়া এককালের মারুফুলের কাছে টাকা এখন তেজপাতা। তার তামাম মোজেজার কথা এখন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে আমেরিকায় ছোটভাইয়ের কাছেও পৌঁছে গেছে। হীনমন্যতায় ভুগে ভুগে যে বড়ভাই কোনদিন বৈদেশে তার ছোট ভাইকে একখানা চিঠি লিখতে পারে নাই, সে এখন ছোট ভাইয়ের কাছে চিঠি লেখে- আয় শারুখুল আয়, দেখে যা আল্লার কুদরত। সে কী না করতে পারে! ছোট ভাই আল্লার কুদরত দেখতে আসে ডাহাপুরে। অবাক হয়ে বড়ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে- কিভাবে এতসব সম্ভব হলো, ভাইজান? তখন বড়ভাই আর উত্তর দিতে পারেন না। ছোট ভাইয়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধুই চোখাচুখি করেন খাদেম দিদারের সাথে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s