লিখেছেন- শাখা নির্ভানা
মাত্র বিশ পচিশ বছর আগে বাঙালি সমাজে যেসব ভূমিপূত্ররা বেঁচে ছিলেন, এখন নেই, তাদের জীবন যাপন প্রণালি, চিন্তা ভাবনা আজকের বাঙালি থেকে এত বেশী ভিন্ন ছিল, যে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তাদের ভিতরে যারা সামাজিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্বসুলভ গুণের অধিকারী ছিলেন, তারাও আজকের নেতৃস্থানীয়দের থেকে ভিন্ন ছিলেন অনেক। তারমানে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাঙালির সামাজিক বিবর্তন উল্লেখ করার মতন। এই বিবর্তন ইতিবাচক, না নেতিবাচক সে প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে মনে আসে। নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে সহজেই বুঝা যায়, বাঙালির সার্ভাইভাল ফিটনেস কিছুটা বাড়লেও তার মরাল ফিটনেস কমেছে দৃষ্টিকটুভাবে উল্লেখযোগ্য হারে। এই সহজ সমীক্ষার উপরে ভিত্তি করে বলা যায়, বাঙালির গড়পড়তা বিবর্তন নেতিবাচক। তাই গত হয়ে যাওয়া ভূমিপূত্রদের জীবন ও সমাজচিন্তার উপরে গবেষণার তাকিদ এসে যায় অতি স্বাভাবিকভাবে। তাদের নিয়ে এই গবেষণার লব্ধ ফল আমাদের আগামীতে পা ফেলার দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেবে। এমনি একজন বিগত দিনের ভূমিপূত্র ছিলেন আমার পিতা, যার চিন্তা, কথা ও কাজের উপরে খুব সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলার ইচ্ছা রাখি। এখানে আত্মপ্রচারের চেয়ে আগামী দিনের পথনির্দেশনার অনুসন্ধানই মূল বিবেচ্য বলে মনে করি।
আমার পিতা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, ত্রিশটা রোজাও রাখতেন। তবে অসুখ-বিসুখ, বড় কোন ভ্রমনে বা অন্য কোন জীবন ঘনিষ্ট জরুরী প্রয়োজনে রোজা ছাড়তেন। ভীষণ দরকারী কোন কাজ, যা পরে করা সম্ভব না, তার জন্যে নামাজও ছাড়তেন। দাড়ি রেখেছিলেন একেবারে শেষ জীবনে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন- সপ্তাহে দুই দিন দাড়ি শেভ করতে বড্ড ক্লান্তি বোধ করি, বিরক্ত হই। ইসলামী পোশাক, ইসলামী পরিভাষার দৈনন্দিন ব্যবহারকে তিনি অনাবশ্যক এবং এসবের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই বলে মনে করতেন। ইসলাম বিষয়ে তার ধারণা ছিল অন্য রকমের। তিনি মনে করতেন- ব্যবহারিক জীবনে সৎ থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সহ সকল মানবিক গুণাবলীতে নিজেকে সমৃদ্ধ করার নাম ইসলাম। আত্মউন্নয়নে নামাজ রোজা হজ্জ জাকাত কাজে লাগে। তবে এসব যদি কেউ অন্য কোন রিচুয়ালের মাধ্যমে করে তবে সেও এক প্রকার মুসলমান। উদাহরণ সরূপ তিনি আল বেরুনির কথা টানতেন। বলতেন, আল বেরুনি ভারতবর্ষে এসে বহু বছর অতিবাহিত করেছিলেন। ভারতীয় যোগীদের কাছ থেকে তিনি চিত্তচাঞ্চল্য দূর করার যোগকলা শিখেছিলেন। কখনও কখনও তিনি আমাদের সামনে নামাজ রোজা অজুর উপকারীতার কথা তুলে ধরতেন, কিন্তু একবারও সেসব পালন করার জন্যে জোর করতেন না। তিনি বলতেন, ধর্ম পালন করাতে হয় মটিভেশনের মাধ্যমে এবং এই ধর্ম পুরাপুরি কমন সেন্সের ব্যাপার, জটিলতর কিছু নয়। এইসব কারণে তার অনেক হিন্দু খ্রিষ্টান বন্ধু ছিল। তাদের সাথে সামাজিকভাবে মিশতেন। হিন্দু বাড়িতে, হিন্দুদের বানানো মিষ্টি খেলে ঈমান চলে যায়, একথা তিনি কস্মিন কালেও বিশ্বাস করতেন না।
১৯৪২ সালের কলকাতা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট ছিলেন তিনি। সেই যুগে মুসলমানদের জন্যে ভাল কোন চাকরী ছিল না, হয়তো রাজনৈতিক কারণে। স্বভাবে মা নেওটা ছিলেন তিনি। তাই সারা জীবন মায়ের পাশে থাকার জন্যে খুলনা সিভিল কোর্টের কেরানী হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। লোকে বলে কোর্টের ইটে ঘুষ খায়। আমার পিতা ও জিনিস কোন দিন ছুঁয়ে দেখেননি, তাই আমারা এক প্রকার দারীদ্রের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। ঘুষকে তিনি মনুষ্যত্বের অবমাননা বলে মনে করতেন। আমার পিতার শেষ ইচ্ছা ছিল, নিজের মতন করে কোরানের তফসির লিখে যাওয়া। তিনি মনে করতেন, সব তফসিরই অসম্পূর্ণ। লিখে রেখে যেতে পারেননি। নিজের চেষ্টায় পাঁচটা ভাষায় বুৎপত্তিগত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন- ইংরেজি, আরবী, ফার্সি, উর্দু ও সংস্কৃত। আমি তেমন কিছু শিখতে পারিনি তাঁর কাছ থেকে। বই পড়ার একটা দোষ ছিল তার। ঐ সময় তাইই মনে হতো। ইংরেজী আর বাংলা সাহিত্যের বাইরে এস্ট্রনমি, এনাট্মি, সাইকোলজি সব বই পড়তেন, ক্ষ্যাপার মতন পড়তেন। ফজরের নামাজ শেষ করে আমার খাটের অনতিদূরে পড়ার টেবিলটার পাশে বসে দখিনের দরজাটা খুলে ভোরের অস্পষ্ট আলোতে শুরু করতেন সুর করে উর্দু বা ফার্সি কাছিদা পড়া। কাছিদা একধরনের পয়গম্বার ও খোদার ইশকের কবিতা। ভোরের ঘুম। বিরক্ত লাগতো, আবার সুরেসুরে একধরণের মাদকতার ঘুমও এসে যেত। চলতো সুরেলা পাঠ। (ফার্সি জানা ব্যক্তিগণের কাবিতাগুলো বুঝতে সুবিধা হবে।)
মাশরেকে হোব্বে মোহাম্মদ মাতলায়ে দিওয়ানে মা
মাতলায়ে খুরশিদে এশকাশ সিনা ইউসু জানে মা।
অথবা, চলতো রুমীর মসনবী থেকে রুবাই পাঠ-
বিষ্ণু আজ নায় চু হেকায়েত মিকুনাদ
আজ জুদায়ি হো সেকায়েত মিকুনাদ।
অথবা,
ছিররে মান আজ নালায়ে মান দূর নেস্ত
লায়কে চাশমো গোশরা নূর নেস্ত।
অথবা,
ইয়া ইলাহী ক্বালবে মজনু নামজে গায়রাশ বাজদার
হোব্বে উকুন বান্দে মায়ো এশকে উ জিঞ্জিরে মা।
এইসব উচ্চ মাত্রার কাব্য গুণে সমৃদ্ধ ফার্সি কবিতা কানের কাছে সুর করে পড়ার কারণে ঘুমের ভিতরেই সেই বালক বয়সে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, যা আজও ব্রেনের ROM থেকে মোছেনি। মেমোরিতে আরও আছে। সেখান থেকে দুয়েকটা বের করে আনলাম। অবসর মত জিজ্ঞেস করতাম পিতাকে- এইসব কেন পড়েন? সওয়াব হয় বুঝি? প্রশ্ন করলে রাগতেন না। উত্তরে বলতেন- সওয়াব হয় কিনা বলতে পারবো না। তবে দুটো কারণে পড়ি, তোরে বলতে পারি- একনম্বর কারণ, এইসব কাছিদার ভিতরে অতি উচ্চ মাত্রায় কাব্যগুণ রইছে। দুইনম্বর কারণ, এসব বিখ্যাত কবিরা একজন সম্মানিত মানুষের নামে লিখিছে। সোয়াব হয় কিনা বলতি পারিনে।
এইসব ফার্সি বাইয়াত পড়ার একটা সুরও আছে, যেটা অনুসরণ না করলে পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। ভোরের মাদক ঘুমের ভিতরে থেকে তাও মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেসবও স্মরণে আছে। সেসব নিয়ে একটা ইউটিউব ভিডিও করবো ভাবছি। তবে উৎসাহ পাই না এই কারণে, যে আমি আসলে ফার্সীর ফ’ও জানি না, ফলে শব্দগত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আমার বাবা জীবনের প্রথম অংশটা সাহিত্যসেবায় ব্যয় করেছিলেন। খুলনা সাহিত্য পরিষদ নামে একটা বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার অস্তিত্ব এখন প্রায় নিবু নিবু। একেবারে আদাজল খেয়ে দিনরাত খাটতেন সেটার পিছনে। যেন ঢাল তলোয়ারহীন এক সেপাই আর কিছু সেপাইসহযোগে পুরা সমাজটাকে বদলে দিতে চায় রাতারাতি। এসব আমি দেখিনি। তার মুখেই শুনা। এই স্বল্প পরিসরে তাঁর বিষয়ে সবকিছু বলে ফেলা আমার জন্যে বেশ কঠিনই। তবে আমার পিতা যে একজন বহুমাত্রীক মানুষ ছিলেন, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। আগে বুঝলে হয়তো অনেক বিদ্যা শিখে রাখতে পারতাম। চ্যরাগের গোড়ায় সব সময় অন্ধকার থাকে। অন্ধকারটা আমার নিজের। তাই ধরতে পারিনি, চিনতে পারিনি তাঁরে।
একদিনের ঘটনা মনে করতে পারি। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি খুলনায় গেছি কাজে ছুটি নিয়ে। রমজান মাস। কে একজন বাবাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা বই, স্ট্যাণ্ডার্ড পাবলিশার্সের ‘ওয়াণ্ডার্স অফ দ্য নাইট স্কাই’ গিফট করেছে। তাই নিয়ে তিনি ডুবে আছেন বাইরের বৈঠকখানায়। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথায় সাদা চুল, সচল এক বৃদ্ধ আস্তে আস্তে বৈঠকখানার দরজায় এসে দাড়ালো। খুব ছোটবেলায় দেখেছি তাকে। নবারুন কাকা, বাবার ছোট বেলার বন্ধু, থাকতেন কুণ্ডু পাড়ায়। এখন থাকেন ওপার বাংলায় সবাইকে নিয়ে। এসেছেন এপারে থাকা স্বজনদের সাথে দেখা করতে। নবারুন কাকাকে দেখে বাবা এলেন ছুটে, নিয়ে বসালেন বৈঠকখানায়। তখন সময় বিকেল তিনটা চারটা হবে। অতিথির মুখ শুকনো। অনেকদূর হেটে এসেছেন। বাবা ভিতর বাড়ি চলে গেলেন। দশ মিনিট পরে এলেন হাতে এক প্লেট পাকা পেপে ও একগ্লাস পানি নিয়ে। ঐদিন ইফতারির জন্যে বরাদ্দ গাছে-পাকা পেপেটা দিয়ে অতিথি সৎকারে মায়ের মৃদু আপত্তি টিকলো না। নবারুন কাকা জিহবায় কামড় দিয়ে বললেন- আরে জলিল, তুই এইডে কি করলি। তুই না রুজা। লজ্জায় পড়লেন কাকা। বাবা হেসে বললেন- আমি রুজা তাতে তোর কি, নবা? তুই তো রুজা না। তুই এত দিন পরে আইছস। আমি বুঝি তোরে খালি মুখে যেতে দেবো? অতিথির সামনে কিছু দিতে পারায় বাবার সংযম সাধনার পূন্যস্রোত আরও বেগবান হয়ে উঠলো। সেই পূণ্যের আভা ফুটে উঠলো তার মুখে। আমার বাবার কাছে রোজা আর মনুষ্যত্ব পরষ্পর বিরোধী কোন ব্যপার ছিল না।
মোটাদাগে এই ছিলেন আমার পিতা। তিনি তিনকাল দেখা একজন মানুষ। একজন মুসলমান। তিনি ব্রিটীশ, এবং পাকিস্তান দেখেছেন, দেখেছেন বাংলাদেশও। ১৯১৬ সালে জন্ম গ্রহণ করে ৮৩ বছর বেঁচে থেকে পৃথিবী থেকে কিছু নিয়ে আর কিছু দিয়ে ১৯৯৯ সালে ছেড়ে গেছেন এই ধরার মায়া। আজ তার ৮৩ বছরের জীবনের খুটিনাটি ঘেটে পরিচিতি সংকটের এই মড়কের যুগে যা পাই, তা অনেকটা এমন- তিনি নিজেকে প্রথমতঃ মনে করতেন একজন মানুষ, দ্বিতীয়তঃ একজন বাঙালী, তৃতীয়তঃ একজন মুসলমান। আজকের দিনে এখনকার বাঙালি মুসলমান সমাজের বিবেচনায় তিনি কি একজন সহি মুসলমান ছিলেন? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের কথা ভেবে হাসি, প্রচুর হাসি, রাগি, অবাক হই, সাথে সাথে চিন্তিতও হই।