শোক থেকে শক্তি


roso

লিখেছেন- রওশনারা বেগম

আজ থেকে ১৬ বছর আগে আমি একটি চির সবুজ দেশ ছেড়ে সাদা বরফে ঢাকা এক ঠান্ডা হিম শীতল এই শহরে এসে পড়ি। সেই স্মৃতি আজ চোখের সামনে ভাসে। এই টরন্টোর রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে কত হেটেছি তার কোন হিসেব নেই। সেই সময়ে এই টরন্টোর মানুষ গুলোকে বড়ই অদ্ভুত লাগতো। এই অপরিচিত লোকের মধ্যে আমার কান্নাটা হয়ত স্বাভাবিক ছিল অথবা হয়তো এই শহরে নতুন আসা বহু মানুষের কান্না দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই হয়তো আমার চোখের জলটুকু তাদের আবেগকে স্পর্শ করেনি। এটাই এই শহরের ধরন। কেন কেঁদে কেঁদে একটি বছর পার করেছিলাম তা বোঝানোর ভাষা আমার নেই। আমার একটা শিকড় ছিল মাটির সাথে, মানুষের সাথে। তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই শহরে এসে আগাছা হয়েছিলাম।

মানুষ জন্মেই স্বাধীন। একটি স্বাধীন স্বত্তা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। আস্তে আস্তে সেই স্বাধীন মানুষটাকে পরাধীনতার জালে বন্দি করা হয় কিছু দুষ্ট চক্রের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, আমিও আস্তে আস্তে বড় হয়ে সে রকম এক পরাধীনতার বাস্তব চিত্র দেখতে পাই। তাই শিক্ষা শেষ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি দেশ ছাড়ার। সেই দিন সেই অবুঝ মনে ভেবেছিলাম দেশের বাইরেই সকল সুখ শান্তি ও আসল মুক্তি রয়েছে। কিন্তু কেন জানি মনে হয় আমি আজও সেই মুক্তি ও স্বাধীন স্বত্তার সন্ধান করে যাচ্ছি। আমি কতটুকু পেরেছি পরাধীনতার থেকে মুক্ত হতে? তা আমার জানা নেই। তবে আমি স্বপ্ন দেখি মানুষ এক দিন পরাধীনতার থেকে মুক্তি পাবেই। এটি একটি চলমান সংগ্রাম। যে সমস্যা বহুল পরিবেশ থেকে অনেক বছর আগে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম আজ ফেলে আসা সেই মানুষ গুলোকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই সুন্দর পরিপাটি শহরের কোন কিছূর মধ্যে আমার কোন আবেগ অনুভুতি নেই। দুঃখী মায়ের কাছে আমার সমস্ত ভালবাসা ফেলে রেখে চুপিচুপি চলে এসে এই শহরের এক নতুন মায়াজালে নিজেকে আবদ্ধ করার আপ্রান সংগ্রামই চালিয়েছি।

মানুষ গুলো ছুটছে যন্ত্রের মত। কেউর কোন সময় নেই যে আমার কষ্টটা বোঝার জন্য কিছুটা সময় ব্যয় করবে। আমি ছিলাম সেই দিন এক নিঃসঙ্গ যাত্রী। আস্তে আস্তে এই শহরের যান্ত্রিক জীবনের স্রোতের সাথে মিশে যাই। নিজেকে এই স্রোতের মাঝে নতুন করে আবিস্কার করি। আজ আমার আর সেই অবুঝ মনের কান্না নেই, আছে কিছু জীবনের এক কঠোর বাস্তবতা। তাই আজ নিজের কোন কষ্ট নেই, অন্যের কষ্টে কাঁদি। দেশের মানুষের কষ্ট দেখে মনের ভাবনাগুলো খুব দাপাদাপি করে। শ্রেনী সচেতন মানুষের মাঝে আমার ঠাই হয়নি। তাই বেছে নিয়েছি জীবনের এক নিজস্ব গন্তব্যকে। এই শহরে এসে আমার মত আরো কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি, যাদের জীবন থেকে পোশাকী ভাবনা মুছে গিয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে নিজস্ব ভাবনার। আত্মীয় কিংবা রক্তের সম্পর্ক ধরে যখনি কাছে যাবার চেষ্টা করেছি, পেয়েছি আঘাত, ফিরে এসেছি নিজের কাছে। তাই আজ আর কেউকে খুঁজি না। নিজের মধ্যে নিজেকেই খুঁজে বেড়াই।

এই সাজানো গোছানো টরন্টোর মধ্যে আমি যা পেয়েছি, তাহলো আমার মানবতার বোধের একটা রূপ যা হয়তো বাংলার ঐ নরম পলি মাটিতে বসে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এই শহরে এসে আমি বিশ্বকে দর্শন করেছি। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের বাসস্থান হয়েছে এটি। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির এক মিলন মেলা। এই সভ্যতার মাঝে মানবতার কোন কমতি দেখি নাই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈষম্য কিছুটা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুশীলিত হয় এক মহান মানবতাবাদী নীতি। তাই পৃথিবীর একটি সুন্দরতম দেশ এই কানাডা। সভ্যতা অনেক দামী জিনিস। টাকার বিনিময়ে সভ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়। দীর্ঘ দিনে কিছু মানুষের শ্রম ও সাধনার ফলে এই সভ্যতা এসেছে। আর এই সব দেশ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মানবতাবোধ ধারন করে দ্রুত সভ্যতার চুড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা এই নরম পলি মাটিতে বসে বসে এদেরকে সাম্রাজ্যবাদী বলে গালি দেই। আমি অস্বীকার করছি না যে তারা সাম্রাজ্যবাদী না। তবে সভ্যতার সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের ধরন পরিবর্তন হয়েছে। এখন সেই আগের মত আর উগ্র রূপ নেই। তবে আমার মনে হয় দেশের ভিতরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলোর তৎপরতা আরো অনেক বেশী। তাইতো এক তরফা একটা নির্বাচন হলেও ভিতর থেকে তেমন কোন প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি।

একটি দেশের মানুষ যদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারে সেখানে বাকী বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখা থাকা ছাড়া আর কি বা করতে পারে? কিছু করার নেই। কারন জনগনই একটি রাষ্ট্রের নিয়ামক। তাই সভ্য বিশ্বগুলো একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সব আনিয়ম মেনে নেয় শুধু ব্যবসার খাতিরে। মানুষের ক্ষমতা অসীম। তার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও সে আবার নতুন করে গড়বেই। আমি ও এক সময় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পাশে একান্ত একজন ছাড়া আর কেহ ছিল না সেই আমি এখন অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে পারি। কিছু কিছু মানুষ থাকবে যারা অন্যের গড়া স্বপ্নকে ভেংগে দিতে পারে, কিন্তু নিজে কিছু গড়তে পারে না। এই মানুষগুলো সমাজে আগেও ছিল এখনো আছে। তারা কারা, তাদেরকে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাই আর হতাশা নয়। সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে কাজে নেমে পড়ুন। তাহলেই জীবনের স্বার্থকতা আসবে। স্বদেশ ত্যাগের যে শোক তা স্বজন বিয়োগের শোকের থেকে কোন অংশেই কম না। আর সেই শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করার সময় এসেগেছে।

2 Comments

  1. একটি দেশের মানুষ যদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারে সেখানে বাকী বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখা থাকা ছাড়া আর কি বা করতে পারে? কিছু করার নেই। কারন জনগনই একটি রাষ্ট্রের নিয়ামক।

    কথাটিতে আপনার চিন্তা কে আমি মন থেকে সম্মান দিতে আর ভালবাসতে পেরেছি ।কিন্তু কষ্ট একটাই আমাদের সকলকে এই ব্যপারটি মাথায় আসতে হবে এবং বুঝতে হবে দেশের সুখ এতেই নিহীত আছে । তবে আমিও মনের মধ্য প্রচন্ড আশা রাখি আপনাদের চিন্তা একদিন পরান পাবে অবুঝ মানুষদের মাঝে । আপনাদের নিজেদের সংগ্রাম থেকে দেশের মানুষ ও শিক্ষা পাবে।
    আপনার দেশের প্রতি মমতা দেখে দেশকে কেন মা বলি আমরা তার অর্থ পেলাম ।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s