লিখেছেন- রওশনারা বেগম
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে দুবাই থেকে ছোট বাচ্চা পলকে নিয়ে এভনিল এই টরোন্টো শহরে প্রবেশ করে। সেই থেকে শুরু হয় তার একার সংগ্রাম। বাইশ তেইশ বছর বয়সে কোন এক প্রেমিকের হাত ধরে ফিলিপিন থেকে দুবাই চলে আসে। সেখানে তারা স্বামী স্ত্রীর মত একসাথে বসবাস করতে থাকে। এই অবস্থায় পলের জন্ম হয়। দুবাইতে তারা অর্থনৈতিক ভাবে তেমন সুবিধা করতে না পেরে কানা্ডায় আসার চেষ্টা করে, ভিসাও পেয়ে যায়। কিন্তু তার বয় ফ্রেন্ড তাকে আশ্বাস দেয় যে সে পরে আসবে। এভলিনও ভেবেছিল পলের জন্যই তাকে আসতে হবে কিন্তু সে আর ফিরে আসে নাই। এভলিনের সাথে সকল সম্পর্কও শেষ করে ফেলে। দূরত্ব হলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়? না অন্য কোন কিছু এর পিছনে কাজ করে? এভলিন অপেক্ষায় ছিল বেশ কয়েক বছর। এখন সেই অপেক্ষায় দিন গোনে না। অন্য কোন অপেক্ষায় এখন সে তাড়িত হয়। যে হাত ধরে একদিন সে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল সেই হাতটি তাকে দূর কোন অজানা দেশে ছুড়ে ফেলেছে। এভলিন তাকে ভুলে গেছে। বেছে নিয়েছে জীবনের নতুন কোন ঠিকানা। কিন্তু এই ঠিকানাগুলো কোন স্থায়ী রূপ পায় না। নিত্য নতুন ঠিকানার জন্ম হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এভলিন সব বুঝেও এই জীবনকে সে মেনে নিয়েছে। তাদেরকে এই বড় শহরে বাঁচার জন্য সহজ পথটি মেনে নিতে হয়। এর থেকে বের হবার জন্য বিকল্প কোন পথ তারা তৈরি করতে পারে না। চলমান পথই তাদেরকে তৈরি করে নেয়। এই ভাবেই চলছে এভলিনের জীবন।
এভলিনেরা এই শহরে হেরে যাওয়া মানুষ হলেও রাষ্ট্রীয় ভাবে তাদেরকে বেশ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। এরপরও এই অবস্থার থেকে কেন জানি তারা আর বের হতে পারে না। এই ভাবেই এভলিনরা নিজেরাই নিজেদের কাছে হেরে যাচ্ছে। আজ এভলিনের বয়স ৩৬/৩৭ বছরের বেশী নয়। নিজেকে গড়ার সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। তার পরেও সহজ পথ থেকে বের হবার মত কোন তুফানের ধাক্কা সে টের পায় না। ভারবাহী ট্রাকের মত জীবনটা কোন রকম বহন করে চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বামী স্ত্রীর সুন্দর সংসার দেখলে তার মনেও স্বাদ জাগে। কোন পুরুষ যদি তাকে নিয়ে সংসার বাধে তাহলে সে সবচেয়ে সুখী মানুষ হবে, এই কথাগুলো আমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে। এই শহরে সে যে চেষ্টা করেনি তা নয়। কেউ নাকি তার সাথে স্থায়ী ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে না। ঘর বাধার স্বপ্নটি তার একান্ত নিজস্ব স্বপ্ন। সবাই ক্ষণিকের আনন্দ নিয়ে সরে যায়। স্থায়ী বাধনে কেউ আর জড়াতে চায় না। এই দুঃখ সে প্রায় আমার কাছে প্রকাশ করে। শারীরিক কোন চাহিদাকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই কিছু দিন বাদেই ছুটে যায় নতুন কোন বয় ফ্রন্ডের খোজে। পেয়েও যায় ব্যর্থ জীবনের ক্ষণিকের আশা পূরণের স্বপ্ন। কিন্তু মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে স্থায়ী সংসার জীবনের বাসনা।
হঠাৎ একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কেমন আছে তোমার বয় ফ্রেন্ড। সে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার ছুড়ে দিয়ে বলে, রাখ ঐ সব কথা। সে কবে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এরা কেউ আমাকে স্থায়ী ভাবে চায় না। শুধু শরীরের লেনদেনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই দেয় ছুট। তাহলে কেন বার বার সেই বন্ধুর খুঁজে ছুটে যাও? আমি তাকে উপদেশ দিয়ে বললাম- ঐ সব বাদ দেও, পড়াশুনা শুরু কর। এভলিন উদাস হয়ে বলে- সে যে কি কঠিন কাজ তা তুমি বুঝবা না। তোমার স্বামী আছে, আমার তো পাশে কেউ নেই এক পল ছাড়া।
এই ভাবে বড় বড় শহরে এসে অনেকেই সঠিক কোন গন্তব্য খুঁজে পায় না। এই ভাবেই সম্পর্কহীন, বাঁধনহীন হয়ে দৌড়চ্ছে তো দৌড়চ্ছে। এই দৌড়ের কোন শেষ নেই। সম্পর্কহীন কোন কিছু যে ভালবাসা নয় তা এভলিন বুঝেও না বোঝার ভান করে সহজ পথেই হাটে। সত্যিকারের বন্ধুত্বে সন্ধান সে আজও পায় নি। তাই বঞ্চনার এক উৎকণ্ঠা তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। কানাডায় জন্ম নেওয়া অনেক অল্প বয়সী মেয়েরা না বুঝে এই ফাঁদে পা বাড়ায়। তখন এর থেকে বেড়িয়ে আসা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
মাতৃত্ব না বোঝার আগেই যে মেয়ে সন্তানের মা হয়ে যায়। এতে ঐ সন্তানও ঐ অবুঝ মায়ের হাতেই অবহেলার শিকার হয়। এ রকম একটি চক্র এই ভাবেই তৈরি হয়েছে। এরপরও এই টরোন্টো শহর অনেকের স্বপ্নের শহর। কারও কাছে এটি স্বপ্ন লুটের শহর, কারও কাছে আবার স্বপ্ন বুননের শহর এটি। এই টরোন্টোতে না আসলে হয়তো জীবনের অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। আবার এই টরোন্টোতে যুগের পর যুগ থেকেও অনেকের কাছে এই শহরের অনেক কষ্টের কথা, অনেক আনন্দের গুপ্ত রহস্য অজানাই রয়ে গেছে। অনেক মেয়েরা মাতৃত্ব বোঝার আগেই কয়েক সন্তানের জননী হয়ে দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবনটা কোন রকম ভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মালবাহী ট্রাকের মতই। আবার আফ্রিকার কোন এক দারিদ্র পীড়িত এলাকার থেকে এসে স্বাধীন মুক্ত হাওয়ার গন্ধ গায়ে মেখে আনন্দের নতুন কোন স্বপ্নের জন্ম দেয়। এই সবই এই শহরে ঘটে যাওয়া সফল ও ব্যর্থ মানুষের জীবন গাঁথা।