গতি ও জীবনের সুস্থতা


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

ব্রুনো, কপার্নিকাসের আগে থেকে শুরু করে গ্যালিলিওর কিছু পরে আমরা ইউরোপে যে খ্রিষ্ট ধর্ম দেখতে পাই তা ছিল বহুলাংশে টোটালিটেরিয়ান বা সর্ব্বময় কর্তৃত্বপরায়নবাদী। ধর্ম আর রাজনীতিকে একসাথে গুলিয়ে মানুষকে খাওয়ানোতে ছিল তার ইহলোক আর পরলৌকিক সফলতার সক্রীয় উপাদান। চার্চ তার সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করার সাথে সাথে প্রথমে ফ্রান্সে পরবর্তীতে মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ডে জ্বলতে শুরু করে রেনেসাঁ বা পূণর্জাগরণের দৃপ্ত মশাল। রেনেসাঁর সেই মশাল প্রজ্জ্বলনে চার্চ যে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস তা মনে রেখেছে। চার্চের প্রাণভোমরা যে নিউ-টেস্টামেণ্ট বা বাইবেল, তার হৃদয়ে কী সেই গ্রন্থিত বাণী, যা সেদিন নতুন যুগের উন্মেষে ভূমিকা রাখতে পেরেছিল, তা একবার খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

ইসায়ী ধর্মের মূল ডকট্রিনের বক্তব্যসমূহকে বিশ্লেষণ করতে গেলে যে সত্যটা বেরিয়ে আসে, তা বহুলাংশে ভাব-ভক্তি রসের ধারায় বিধৌত হলেও তার ইতিবাচক প্রভাবকে অস্বীকার করার কোন রাস্তা নেই। বাইবেলকে সারসংক্ষেপ করলে পাওয়া যায়, যিশু সমস্ত মানব জাতির পাপকে নিজ শরীরে ধারণ করে নিজের জীবনকে ক্রুশকাষ্ঠে বলী দিয়েছিলেন সেই মানব জাতিকে পাপমুক্ত করার উদ্দেশ্যে। ক্ষমা করতে পেরেছিলেন নিজের উপরে ঘটে যাওয়া অপরাধের। খ্রীষ্ট অনুসারীদের এই দৃষ্টান্ত যে মনস্তাত্ত্বিক পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম তা সামাজ উন্নয়নে ইতিবাচকতা তৈরিতে আগেও যেমন সহায়তা দিয়েছিল আজও তেমনি দেয়। কিভাবে সেটা সম্ভব, তা পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসতে পারে।

ভাল কোন কথা শুধু মুখে উচ্চারণ করা নয়, কাজে পরিণত করার শক্তি তখনই মানুষ পায়, যখন সে তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ও তা অনুশীলনে ইতিবাচক ফলাফল পেতে থাকে। অপরাধী নয়, অপরাধকে ঘৃণা করো- এই অপ্ত বাক্যের ব্যবহারিক প্রয়োগে তখনই মানুষ সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত হয়, যখন তারা মনে করে, ঘটে যাওয়া কোন পাপ বা অপরাধের দায় শুধু অপরাধীর একার নয়, অন্য সবারও। সবার কোন না কোন দায়ীত্বহীনতার ফল সেই ঘটে যাওয়া অপরাধ। এই সর্বাত্মক অপরাধবোধ বা গিল্টি ফিলিংস সব মানুষকে অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করে এবং ভবিষ্যতে সেই অপরাধ প্রতিরোধে সক্রীয় করে তোলে। তখন তাদের হাত পা মেধা মনন সক্রীয় হয়ে উঠে অপরাধের বিরুদ্ধে। এই স্পিরিটটাই যিশুর ক্রুসিফিকেশন মিথের মাঝখানে প্রথিত হয়ে আছে, যা একটা উন্নত সমাজ গঠনে কাজ করে যায় নিঃশব্দে নীরবে। অতীতের এই ধর্মীয় সংস্কৃতি সেদিন ইউরোপের মানুষকে রেনেসাঁর নামে যে ভূমিকা রেখেছিল তা আজও বহাল আছে বলে মনে হয়, তবে তা অন্য নামে, অন্য ভাবে অন্যে ভঙ্গিমায়। মূল বিষয় হতে পারে এমন, ভাল জিনিস তা সে ধর্মের ভিতরে থাক আর বাইরে থাক, নিজের সংস্কৃতির ভিতরে থাক আর অন্যেরটায় থাক, সেসব আত্মিকরণে কোন সংশয়, সংকোচ থাকা উচিৎ নয়।

অন্যের অপরাধের জন্যে নিজে লজ্জিত হওয়ার সংস্কৃতি উন্নত মন ও সমাজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। একজন পুরুষ যদি তার পুরুষ প্রকৃতি চরিতার্থ করতে কোন নারীর উপরে চড়াও হয়, তাহলে সমস্ত পুরুষ জাতি তার জন্যে লজ্জিত ও অপরাধবোধে ভুগবে এটা সুস্থ্য ও স্বাভাবিক সমাজের পূর্ব শর্ত। এই বোধ একটা উন্নত সমাজ তৈরীতে সহায়ক হবে কোন সন্দেহ নেই। একজন মুসলমান বা হিন্দু যদি তার বিশ্বাসকে মূল্যায়িত করতে কোন অপরাধে শামিল হয়, তার জন্যে প্রত্যেক হিন্দু বা প্রত্যের মুসলমানের লজ্জিত হওয়া উচিৎ। অপরাধীকে ঘৃণা আর গালাগাল দিয়ে আলাদা করে দিলে যতটা না ভবিষ্যতে সেই অপরাধ ঘটার সম্ভাবনা কমে, তার চেয়ে বেশী ফলদায়ক হয় অপরাধের লজ্জা, দায় ও নৈতিক অংশীদারিত্ব সবাই ভাগ করে নিয়ে যার যার অবস্থানে থেকে অপরাধের বিপক্ষে সোচ্চার হলে। ঠিক তখনই সম্ভব, অপরাধী নয়, অপরাধকে ঘৃণা করো- এই অপ্তবাক্যের সার্থক প্রতিষ্ঠা।

নারী প্রকৃতি, পুরুষ প্রকৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলবাদীতাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে কৃত অপরাধের বাইরেও রয়েছে আরও অগুণিত অপরাধের সাম্রাজ্য। সব অপরাধের বেলায় একই সূত্র- অপরাধী নয়, অপরাধ ঘৃণাযোগ্য। একজন অপরাধীর ভিতরে অপরাধ ঘটানোর যে দক্ষতা ও অপশক্তি, ঠিক সেই একই বস্তু রয়েছে একজন ভাল মানুষের মধ্যে, শুধুমাত্র বস্তুটা চর্চিত হয়নি তার দ্বারা, তাই সে ভাল মানুষ। তাই নিজেদের অন্যগ্রহের মানুষ ভাবার কোন কারণ নেই। এমন ভাবনা বহণকারী মানুষের সমাজে সম্ভব, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে পরস্পর, এই অমীয় বাণীর সার্থক রূপায়ণ।

জার্মানির এমানুয়েল কাণ্ট মনে করতেন, ভাব জগতকে পরিপুষ্ট করতে ধর্মের উদ্ভব হয়নি। সম্পূর্ণ বাস্তবতার মুখোমুখি হবার জন্যে বিশ্বাসের জন্ম। অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করতে তার রূপায়ণ। তা যতই যুক্তিহীন হোক, যতই ছেলে খেলা হোক, মানুষের একটা অসহায় অংশকে সে শক্তিশালী ও সম্পূর্ণ করে। তবে তার সংস্কারিক চলমানতা অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতা অস্বীকার করলে স্থবির হয়ে পড়তে পারে জীবন। তবে এই অর্থে কাণ্ট ধর্মের স্থিতিকে উড়িয়ে দেননি। তবে কাণ্টের সব টেক্সট পড়েও সে বিশ্বাসী না অবিশ্বাসী তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই তাকে নিয়ে আস্তিক ও নাস্তিক উভয় দলের টানাটানি চলে। সব দার্শনিক যে ধর্ম বিষয়ে একই ধারণা পোষণ করেন তা কিন্তু নয়। ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল তো ধর্মের কেন্দ্র বিন্দুতে বসে থাকা ঈশ্বরকেই বাতিল করে দিয়ে র‍্যাশনালিজমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সে যাই হোক ধর্মের নিত্যতাকে ধ্রুব ধরে নিয়ে এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকার ভিতরে যেমন আমাদের পশ্চাদপদতার প্রামান্য দলিল রয়ে গেছে, ঠিক তেমনি পশ্চিম ও ইউরোপের অগ্রগামীতার রহস্যও প্রচ্ছন্ন রয়েছে তার সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের চলমান বিবর্তনের মাঝখানে।

এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে খ্রিষ্টীয় চার্চ কীভাবে বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। কি পারেনি তারা। সমলিঙ্গ বিবাহ, স্যরোগেশন, ইউথেনেশিয়া, এবোর্শন সব তারা কেন্দ্রীয় বিশ্বাসের সাথে আত্মীকরণ করে নিতে পেরেছে। আগামীতে যে মানব ক্লোনিং, যৌনসঙ্গী হিসাবে হিউম্যনয়েড রোবটসহ আরও বহুবিধ আপদ-বেদাত আসছে ধরণীতে, সেসবও তারা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করে নেবে সন্দেহ নেই। ধর্মের এই গ্রহণ করার সক্ষমতা সামাজিক উন্নয়নের উর্ধমুখী সূচক। অন্যকোন ধর্মবিশ্বাসের কথা জানি না, নিজেদেরটা জানি। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে আমরা আমাদের বিশ্বাসের সংস্কৃতিকে এই একবিংশ শতকে এসেও সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারিনি। লক্ষ লক্ষ নারী পোশাককর্মীদের ঘরের বাইরে এসে কাজ করার দরকার নেই, কারণ তারা বাইরে এসে জেনা করে, ব্যভিচার করে পুরা দেশকে দোজকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির মুখ দিয়ে এই শতাব্দীতে এসে এখনও আমাদের এমন সব বাণী শুনতে হয়। এইসব জিনিস সাথে নিয়ে কীভাবে আমরা একবিংশ শতকের চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা করবো?

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে খ্রিষ্টীয় চার্চ আসলে অনেক কিছু শিখেছে। তারা শিখেছে কিভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। কিভাবে প্রচলিত সমাজ ও সংস্কৃতির উল্টোমুখী স্রোতে না চলে তাকে অনুসরণ করতে হয়। কিভাবে মানুষের আশা আকাঙ্খার মূল স্রোতকে গ্রহণ করার সক্ষমতা বাড়াতে হয়। তাদের এই শিক্ষাটা যে আপোষে সম্পন্ন হয়েছে তা না। সমাজের মূল ধারার বুদ্ধিবৃত্তিক চাপ ও গণদাবীর চাপ তাদেরকে একগুয়েমীর পথ থেকে সরে এসে জনবান্ধব হতে অনেকটা বাধ্য করেছে। এসবের প্রামান্য দলিল রয়ে গেছে ব্রুনো, কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর উপরে তাদের মৃত্যু ও নির্যাতনের দণ্ড চাপিয়ে দেয়ার দৃষ্টান্তসমূহের ভিতরে। সেই সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের ঐতিহাসিক আবর্ত এখন যে আমাদের বহুসমস্যা জর্জরিত জনপদে বিরাজ করছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়। একইভাবে আমাদেরও পূনর্জাগরণ সম্ভব যদি এই জনপদের মূল বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি রাজনীতি ও ধর্মের মিলিত অবৈধ প্রেমের ভ্রষ্টালয়ে আঘাত করে চিরবিরহের রাগিনী জাগাতে পারে। এছাড়া মুক্তির আর কোন বিকল্প নেই।       

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s