নারীদিবসের স্মরণে কিছু কথা, কিছু আশা


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

সবেধন নীলমনি, বাঙালীর একমাত্র গর্ব একাত্তর ধীরে ধীরে বেশ পুরান হয়ে যাচ্ছে। এটা সময়ের ধর্ম। এভাবেই চলে এসেছে অনাদি কাল থেকে। আর দুই প্রজন্ম পরে আমাদের মতন ঘন ঘন একাত্তর প্রসঙ্গ টেনে আনা লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তবে একাত্তরকে টেনে আনতে না পারলেও একটা জিনিস আমাদের সাথে সাথেই চলে আসবে, হাটবে, খেলবে সমানে। সেটা আমাদের একাত্তর পরবর্তী পাপরাশি।

প্রথমেই আসি বীরঙ্গনা প্রসঙ্গে। তাদের আমরা আমাদের গর্বের অংশ মনে করি, এতবড় শিক্ষা আমাদের কোন কালেই ছিল না। কিন্তু আমাদের সহনশীলতা ছিল, বঙ্গজ নম্রতা ছিল। সেসব দিয়ে আমরা তাদের আমাদের পাশাপাশি চলবার অধিকারটুকু দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা দিতে পারিনি। আমরা কি দিয়েছি? আমরা তাদের সর্বাত্মক ঘৃণা দিয়েছি। তাদের একাংশকে আত্মহত্যা করে মরবার পথ করে দিয়েছি। আরেকাংশকে স্থায়ীভাবে পতিতালয়ে চলে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। দুয়েকটা ব্যাতিক্রম ছাড়া বাকী অংশকে করেছি সামাজিক পতিতা বা সোসাইটি গার্ল। এই পাপ আমাদের ছাড়বে না। এই ঐতিহাসিক কর্মের মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মকে যে মেসেজটা দিয়েছি, তা হলো- ধর্ষক নয়, ধর্ষিতাই অপরাধী, ঘৃণ্য। এই মেসেজ না দেয়াটা বা ইরেজ করে দেয়াটা কাদের দায়িত্ব ছিল? দায়িত্বটা ছিল রাষ্ট্রের, রাজনীতির, মিডিয়ার, শিক্ষা বিভাগের ও যাবতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের। এইসব দায়িত্বহীনতার জন্যে নারীর বুনিয়াদি নেতিবাচক ভাবমূর্তীটা আরও মজবুত হয়েছে। যুদ্ধশিশুদের সাথে আমরা কী করেছি, কী ব্যবহার দিয়েছি তা আমরা সবাই জানি।  

আমাদের বঙ্গজ রাজনীতিতে এক ধরণের বজ্র আটুনী ফস্কা গেরো ও সুবিধাবাদিতা রয়েছে, যার আশ্রয়ে ধর্ম তার স্বমূর্তী নিয়ে রাজনীতিতে গেড়ে বসেছে। আর ধর্মের চৌহদ্দীতে নারীর অবস্থান কোথায় সেটা নতুন করে বলার কোন দরকার আছে বলে মনে করি না। একদিনে হঠাত করে ধর্ম এসে সমাজে নারী আর পুরুষের স্টেরিওটাইপ ইমেজ তৈরী করে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছে এমন নয়। একটু একটু করে সাবধানী পায়ে তারা রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রকে গিলে ফেলেছে, যেখান থেকে বেরিয়ে মুক্ত আলো-বাতাসে আসা প্রায় অসম্ভব। ইউনুস নবীর মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসা যতটা সহজ ছিল, রাজনীতিকে ধর্মের পেট উদর থেকে বেরিয়ে আসা ততটাই কঠিন। এখানেই নিহিত রয়েছে নারী জাতির পতন দশার মূল কারণ।

আজকে যারা সাতই মার্চের মিছিল থেকে দিনে দূপুরে একজন নারীর উপরে যৌন নির্যাতন করেছে, তারা আসলে ঐ সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ও রাষ্ট্রের থেকেই উদ্ভুত মানব সম্পদ। আগামী দিনের নেতৃত্ব আসবে এইসব মিছিল থেকে কোন সন্দেহ নেই। আগেও যে আসে নাই এমন নয়। এই নেতৃত্ব দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি নারীকে যে নজরে দেখবে, সেভাবেই নির্নীত হবে তাদের সামাজিক অবস্থান। এই পতিত দশা নারীর একার নয়। পতিত হবে পুরুষও। যাকে টানিছ নীচে, সে তোমাকে টানিছে পিছে- এই বিশ্বজনীন নিয়মের ধারায়। যারা মনে করছেন, সাতই মার্চের এই কদাচার বিচ্ছিন্ন একটা নারীর অসন্মান এবং এটা শুধুমাত্র পুলিশ, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ইত্যাদির হুমকি ধমকীতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তারা প্রকৃতই একটা ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন। এখান থেকে জাতিকে টেনে বের করে আনার অনন্য উপায় হচ্ছে, এখনই শুরু করা সঠিক শিক্ষা, যে দায় ও দায়িত্ব রাষ্ট্রের, মিডিয়ার, প্রতিষ্ঠানের। যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির উপর থেকে ধর্মের আছর কমিয়ে ফেলতে হবে, কারণ ধর্মে নারীর অবস্থান সাতই মার্চে তৈরি করা ঐ অসন্মানের থেকে কোন অংশে ভাল কিছু নয়। শুধু পুলিশ দিয়ে বইমেলা থেকে উস্কানিমূলক বই বেরিয়ে আনলেও আনা যেতে পারে, কিন্তু শুধু পুলিশের ধমকি দিয়ে সব শান্ত করে নারীকে তার মর্যাদা আর সন্মান্টুকু ফিরিয়ে দেয়াটা আসলে হবে সোনার পাথর বাটি।

কথায় আছে, বিড়াল মারতে হয় শেষ রাত্রে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অপশিক্ষাসহ শিক্ষার যত রকম মাহামারী আছে সবগুলোই মারা উচিৎ ছিল শেষরাতে, মানে সেই স্বাধীনতা, স্বাধীকার পাওয়ার পরপরই। কিন্তু কে মারবে এবং কেন মারবে? এই প্রশ্নদ্বয়ের উত্তর দিতে গেলে রাজনীতি ও তার রোগ-বালাই, মাহামারী বিষয়ে বিশদ আলোচনা না করে কিছুই বোঝানো সম্ভব নয়। সে এক জটিল পতনের গল্প। এই পরিসরে সেসবের আলাপ সম্ভব নয়। তাই যে নারী দিবসে নারী সমাজের উপরে চাপিয়ে দেয়া সামাজিক বিপর্যয়ের কথা বলতে এসেছি, তাইই বরং বলে যাই। এখন যা অবস্থা তাতে মন হয় কুশিক্ষার বিড়াল প্রায় মধ্যগগনে। তার মানে বারোটা বাজতে আর বেশী বাকী নেই। তাহলে বিড়াল মারতে হলে আরও একটা শেষরাত কি আসতে হবে? তার মানে আরও একটা বিপ্লব। আরও একটা একাত্তর। সেটার সম্ভাবনা কতটা জানি না, তবে একটা সম্ভাবনার প্রদীপ তার ক্ষীণ সলতে নিয়ে এখনও দেদীপ্যমান। সেটা সুশিক্ষার সুযোগ। নারীর সামাজিক অবস্থান উন্নয়নে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই, একথা আমি যেমন জানি, আপনিও জানেন। আমরা কি জানি না- নারীর প্রতি মাত্রাছাড়া কৌতুহল তাকে বিপদে ফেলে, আর এই কৌতুহলের মাথা মুড়ে দেয়া যায় সহশিক্ষার মাধ্যমে? কিন্তু কেন তা করি না? তাই নারীর প্রতি প্রকাশ্য দিবালোকে, অনেকটা বৈধ হয়ে যাওয়ার মত করে সেক্সুয়াল মিসকণ্ডাক্টের মতন অপরাধ রুধবার জন্যে স্বাস্থ্য-পরিবেশ-লিঙ্গ জ্ঞান, যৌনতার জ্ঞান, ইত্যাদি মাত্রা ভেদে সকল শ্রেণির পাঠ্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। তবে লিঙ্গঘটিত কোন অপরাধ ঘটে গেলে পুলিশের সাথেসাথে সমাজকর্মীদের একসাথে কাজ করার আবশ্যকতা রয়েছে। আমাদের দেশের সর্বময় ক্ষমতায় রয়েছে এখন চেতনার সরকার। তাই সেই ক্ষমতা, প্রশাসন, রাজনীতিকে যেভাবে হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, অথবা প্রভাব খাটিয়ে এইসব কাজ করাতে হবে সমাজের জন্যে, সমষ্টির জন্যে, ব্যক্তির জন্যে। সেটা না হলে আর কোন উপায় দেখি না। তা না হলে, ক্রমাগত এইসব রাজনৈতিক মলেষ্টেসন ঘটে যাবে, আর আমাদের মতন ঢাল-তলোয়ারহীন গণেরা সোশাল মিডিয়ায় গুটিকয় রাস্তায় জন্মে রাস্তায় বেড়ে ওঠা সংকর-মানবদের গালমন্দ করে দায় শেষ করে ঘরে ফিরে যাবে। কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s