নিষেধের বন্দী পাখি


khali

লিখেছেন- শাখা নির্ভানা

 

এই রুমে রোকেয়ার বসবাস প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট, তার সাথে দুটো টেবিল ও চেয়ার। আরও আছে একটা মাঝারী আকারের বুক শেলফ। কর্মজীবি মহিলাদের হোস্টেলের এই রুমটা অন্যগুলোর থেকে বেশ বড় এবং স্পেশাল। এর দক্ষিনের জানালাটা খুললে ধুধু মাঠ, মাঠের শেষে একটা বড় কারখানা, সম্ভবতঃ পোশাক কারখানা হবে। উত্তর দিকের জানালা জুড়ে আছে ঝাকড়ানো কৃষ্ণচুড়ার বড় বড় ডাল। গরমের দিনে উত্তর আর দক্ষিণের জানালা খুলে দিলে তার রুমটা হয়ে যায় স্বর্গের বাগান। এই রুমের বাসিন্দা দুইজন- রোকেয়া আর রোচি। তারা হরিহর আত্মা, তারা দুইজন বান্ধবী। নামে যেমন মিল, কাজেও তেমনি। ওরা দুইজন কাজ করে একটা বড় বানিজ্যিক অফিসে- প্রবেশনারী অফিসার পদে।

রোকেয়ার শরীরটা আজকে ভাল নেই। গাটা ম্যাজ ম্যাজ করছে, মাথাও ভার। থেকে থেকে গায়ের বাড়িতে থাকা মায়ের কথা মনে আসছে। রোকেয়ার একটা খুব গোপন কথা আছে, এই পৃথিবীতে দুইজন মানুষ তা জানে, সে আর তার মা। বাবাকে বলার কথা ছিল, কিন্তু মা তাকে তা বলতে পারেনি। মরার আগ মুহুর্তেও মা তাকে বলতে পারেনি। হয়তো বলতে চায়নি। মা বলে দিয়েছে- এইকথা কেউ জানলে তুই সব হারাবি। তুই মারা যাবি, রোকে। কাজের থেকে একটু মুক্তি পেলেই এইসব কথা ভাসে তার মনে। আজকে বিষ্যুতবার। আজ তার এইসব কথা মনে আসার কথা, তাই আসছে। এই ব্যাপারে তার কিচ্ছু করার নেই।

image004

রাত বেশী হয়নি। রোকেয়া তার খাটে শুয়ে জেগে জেগে একটা স্বপ্ন দেখছে। সে দেখছে- কিভাবে তার মা বাবার সামনে তাকে মেয়েদের কাপড় পরিয়ে রাখতো। কিভাবে তার কাপড় জামা পাল্টানোর কাজ থেকে বাবাকে সব সময় দূরে রাখতো। তাই তো বাবাসহ সারা পৃথিবীর লোক জেনে গেছে সে আসলে একটা মেয়ে, ভাল মেয়ে, সুন্দরী মেয়ে। বাইরে যতখানি মেয়েই সে হয়ে থাক, তার পুরুষ চিহ্নটা লুকানো আছে, হয়তো চিরকাল লুকানো থাকবে শরীরের কেন্দ্রের গভীরে, পরিচ্ছদের অন্ধ খাজে। মুখে বিড়বিড় করে সে- মা তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ, পাহাড় সমান। মা হয়ে আমাকে জন্ম দেয়ার থেকেও বড় ঋণ। বিড়বিড় করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে যায় রোকেয়া। পাশের খাটে পড়ে নাক ডাকছে রোচি।

রাজার বাড়ির বাঁদী এখন রোকেয়া। পরনে তার নারীদের ঝলমলে পোশাক। রোকেয়া জানে তাদের রাজা কত বড় সম্রাট, আর কত অঢেল তার মনি মানিক্য। সোনার পানদানিতে আরও অনেকের সাথে পান সাজাচ্ছে রোকেয়া। হঠাৎ প্রাসাদে এলান হলো- রাণীর হিরক খচিত ছোট্ট একটা পেয়ালা চুরি গেছে। বাঁদীরা, তোমরা সবাই লাইন দিয়ে দাড়িয়ে যাও। শরীর তল্লাশী হবে। এলান শেষ হবার সাথে সাথে সব বাঁদী লাইনে দাড়িয়ে গেল। সবার সাথে রোকেয়াও দাড়ালো। লাইনের একটু সামনে কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। সেখানে একটা একটা করে বাঁদী নিয়ে কাপড় খুলে তল্লাশী চালাচ্ছে মহিলা সান্ত্রি। ওদিকে রোকেয়া ঘেমে কেঁদে দুনিয়া ভাসাচ্ছে। সবাই যখন জানবে সে নারীবেশী পুরুষ, তখন কী যে হবে! তাকে কেটে দুই টুকরো করবে রাজার সেপাইরা। তার উপরে লজ্জা অপমান তো আছেই। কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছে না সে। উপরওলার কাছে করুন আর্তনাদ করতে লাগলো সে- হে খোদা, এবারের মতন আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি- আমি বাদীগীরি ছেড়ে দিবো। জানাজানি হলে আমাকে তো সমাজে কেউ নিবে না, বাকী জীবনটা আমি বরং জঙ্গলেই কাটিয়ে দেবো ঈশ্বর। তুমি আমারে বাঁচাও। রোকেয়ার ঠিক সামনে দাড়ানো মেয়েটার কোমরের খুঁটে পাওয়া গেল সোনার পেয়ালাটা। লাইন ভেঙ্গে দেয়া হলো। যে যার মতন কাজে চলে গেল।

প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রোকেয়া। তার কান্নার পরিমান বেড়ে গেল আরও। সামনে বেশ কিছুটা দূরে ঐ যে জঙ্গলটা দেখা যায়, ওখানে যেতে চায় সে। ওখানে সে কাটিয়ে দেবে তার বাকী জীবনটা। সে বাইরে পূর্ণাঙ্গ মেয়ে, কিন্তু এক গভীর অঙ্গে সে পুরুষ। কেমন করে সেটা মানুষ মেনে নেবে। এই ধাঁধার কোন কিনার নেই। কুল নেই। রোকেয়া তাই হাঁটছে। সে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

সকাল প্রায় হয়ে এসেছে। পূব আকাশ সাদা হয়েছে মাত্র। সূর্য্য এখনও জাগেনি। রোচি পাশের খাটে শুয়ে তখনও নাক ডেকে যাচ্ছে। নিজের কান্নার শব্দে নিজেই জেগে গেছে রোকেয়া। ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখে চোখের পানিতে বালিশ ভিজে জবজব করছে। সে কি স্বপ্ন দেখছিল? স্বপ্ন কি এতটা বাস্তব হয়? মনটা তার পাহাড়ের মতন ভারী হয়ে আছে। বালিশটা উলটে ফেলে আবার একটু শোয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। পাশের খাটে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা রোচির দিকে চোখ যায় তার। রোচিকে তার ভাল লাগে। সে এক অন্য রকমের ভাললাগা। যদি রোচি কোনদিন খোঁজ পেয়ে যায় এই ভাললাগার! সেদিন কী হবে? রাজপ্রাসাদের ঐ বাঁদীর মতন হবে না তো? আর বেশীদূর ভাবতে পারে না সে। নিজেকে নিজের ভিতরে গুটিয়ে নেয়। ছোট ছোট পা ফেলে দক্ষিণের খোলা জানালাটার পাশে গিয়ে দাড়ায়। আকাশের গায়ে একটা বড় তারার দিকে তার চোখ গিয়ে আঁটকে যায়। কেমন স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে জ্বলছে। যেন তার বাবা মরে গিয়ে আঁটকে আছে আকাশে গায়ে। জানালা দিয়ে দুই হাত বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে- বাবা, বেঁচে থাকতে আমাকে তোমার মেয়ে বলে জেনে গেছ, আজ দেখ দুই পরিচয়ের যাতাকলে কীভাবে আমি পিষ্ঠ হচ্ছি। দেখে যাও বাবা, দেখে যাও। কেউ তার ফিসফিসানি কথা শুনতে পায় না, কেউ উত্তরও করে না। শুধু শেষ রাতের একটা শীতল মলিন বাতাস মায়ের স্নেহের মত ভালবাসার স্পর্শ লাগিয়ে দিয়ে যায় তার চোখে, মুখে, সারা শরীরে।  

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s