সংস্কারের দায় লেখকের কতটা!


khali

লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

লেখকের মনের কথা অকপটে প্রকাশ করা যায় কবিতার থেকে প্রবন্ধের ভিতর দিয়ে বেশী। আবেগ আর তথ্যের মিশ্রণে যে উলঙ্গ বাস্তব প্রকাশ তার নামই প্রবন্ধ। আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম একবার তার এক প্রবন্ধে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন অনেকটা এইভাবে- আমি যুগের কবি নই। আমি হুজুগের কবি। এই দুই বাক্যে নিহিত কবির ভাবকে তর্জমা করলে অনেকটা এমন দাড়ায়- যে দক্ষতার গুণে কোন কবি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকেন, সেইসব আমার নেই। বর্তমানকে ধরে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে, তাইই আমি করে যাব। কবি তাই করে গেছেন। তারপরেও কবি টিকে আছেন যুগ যুগ ধরে। এসব কি নিছক প্রতিভার বিনয়, নাকি অন্য কিছু? কিছুটা সেই অনুসন্ধান প্রচেষ্টা করতে চাই এই নিবন্ধে।

কবি নজরুলের সাহিত্যচর্চা কালের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় চব্বিশ বছর। সময়টা ছিল পরাধীনতার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও দাসত্বের। ঐ সময়টার দাবী ছিল এইসব অন্যায়-দুঃশাসনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া। তাই তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, গল্প সবসৃষ্টির মধ্যে এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই সমসাময়িকতার দাবীকেই তিনি হুজুগ বলে অভিহিত করেছেন। তাই তিনি নিজেকে হুজুগের কবি বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি। কবির জন্ম হয় ১৮৯৯ সালে। মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালে। এই সাতাত্তর বছরের নাতিদীর্ঘ পরমায়ুর মধ্যে মাত্র চব্বিশ বর্ষকাল তার লেখালেখির জীবন। তার সাহিত্যসৃষ্টির অবসান হয় ১৯৪২ সালে এক ভয়াবহ দুরারোগ্য অসুস্থতার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সত্যকথা বলতে গেলে স্বীকার করতে হবে- তার অমর সৃষ্টিগুলো পঁচাত্তর বছরের পুরানো। আমাদের মূল প্রশ্ন ছিল তার এইসব যদি হুজুগে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তা কেন আজও বেঁচে আছে? কেন মরে যায়নি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যে।

১৯৪৭ সালে হুজুগ কেটে গেল। ইংরেজ বিদেয় হলো। দাসত্ব গেল ঘুচে। সর্বনিয়ামক রাজনৈতিক আকাশে উদয় হলো নতুন তারকা। ব্রিটিশ তিরোধানের পরপর স্বাধীন জলবায়ুতে মানুষ নিশ্বাস নিতে থাকে। দামামা বাজানো নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আর তেমন থাকার কথা নয় স্বাধীন দেশে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটলো না। যত দিন যেতে লাগলো নজরুল ততো বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে লাগলো বাঙালীর কাছে। দুখুমিয়ার চাহিদা ১৯৭১ সালে এসে একেবারে তুঙ্গে পৌঁছল। যে নজরুলকে দরকার হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগে, ১৯৭১ সালে এসে সেই নজরুলের চাহিদা, জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করলো। ভুত তাড়ানোর জন্যে যেমন ভীত মানুষের কাছে রামনাম স্থায়ী হয়ে যায়, তেমনি যেন নজরুল স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে নিলো নির্যাতিত মানুষের মুক্তিতে উদ্দীপনা যোগাতে। তিনি কি ভুত তাড়ানো রাম?

কী সেই ভুত? কোথায় থাকে সেই ভুত? ভুত সব সময়ই বিমূর্ত, অদৃশ্য জগতের জীব। গভীর ভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বাঙালীর চেতনায় বাস করে সেই ভুত। সেই ভুত বাঙালীকে দুঃশাসনের মূলোৎপাটন করতে দেয় না, কিন্তু বিপ্লব করতে দেয়, বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করে। কুশাসন মূলোৎপাটিত হবে তার গুণপনার পরিবর্তনে, তার সাংস্কৃতিক বিবর্তনে। কিন্তু সেদিকে সে যায়নি। নগদ লাভের আশায় সে শুধু রাজা পাল্টিয়েছে। সে রাজা পালটাবার বিপ্লব করেছে। ১৯৪৭ সালে সে রাজা পাল্টিয়েছে। ১৯৭১ সালে সে রাজা পাল্টিয়েছে। কিন্তু তার দেহ-মন ছেড়ে দুঃশাসনের দুঃস্বপ্ন তিরোহিত হয়নি। তাই নজরুলের চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতা একটুও না কমে বরং বেড়েছে। নজরুল তাই রাজা-হটানো বিপ্লবের রামনাম। একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে- এই দুঃশাসনের হুজুগ যদি সৌভাগ্যক্রমে কোনদিন না থাকে, তবে কি দুখুমিয়া বাঙালীর দুঃখের আকাশ থেকে খসে পড়া তারার মত অদৃশ্য হয়ে যাবে?

রামের বিদায়ের আর কত বাকী? এই প্রশ্নের জবাবে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। আমেরিকায় বাস করা এক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে, যিনি সেখানে ব্যবসা করে অনেক অর্থের মালিক হয়েছেন। একদিন তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশী কোন ভাল নাটক আছে কিনা, যা দেখে সে তার চিন্তা ও চিত্ত উভয়কে বিনোদিত করতে পারে। আমি তাকে সেলিম আল দিনের একটা বিশেষ নাটক  দেখার জন্যে অনুরোধ করলাম। তিনি নাটকটা দেখে আমাকে ফোন করলেন। তিনি বললেন- ‘ভাই, নাটকটা আমার ভাল লাগেনি। গরীব মানুষের নাটক এখন আর ভাল লাগে না’। এখানে তার এই কথায় মরালটা যা পাওয়া গেল- দারিদ্র একবার কেটে গেলে, দারিদ্র নিয়ে রচিত শিল্প-সাহিত্য অনাবশ্যক আবর্জনা মনে হবে। দুঃশাসন কেটে গেলেও তাই হবে। এটা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। ১৯৪৭ এর হুজুগ বা ভুত এখনও বাংলায় বর্তমান, সেটি কেটে গেলে নজরুলও মুছে যাবে বাঙালী মনন থেকে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, নজরুল কি শুধু রাজা হটানো বিপ্লবের গান লিখেছেন, ধ্রুপদী কোন রচনা কি তার নেই? তাহলে কেন তিনি মুছে যাবেন?

রাজার অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ রুখে দেয়ার উদ্দীপনার বাইরে নজরুলের যে সৃষ্টিসম্ভার আছে তা বুঝতে হলে একটা ভাল বিদ্যাপীঠ, একজন ভাল গুরু, একজন ভাল নূরুল ইসলাম নাহিদ, সর্বোপরি একজন শাণিত শিক্ষার্থীর দরকার হয়। তার সরবরাহ কি নিশ্চিত করা গেছে? আগে তো পাত্র, পরে রশদ। পাত্রই যদি তৈরি না হয়, তাহলে ধ্রুপদী নজরুলকে কোন বাঙালী-পাত্রে রাখা হবে? অর্থাৎ ধ্রুপদ-নজরুল বাংলায় সেই অর্থে বেঁচে আছে বলে আমার মনে হয় না। তারপরেও সে থাকবে গুটিকয় মানুষের ভিতরে, শিল্পের প্রয়োজনে, শিল্প-বাণিজ্যের প্রয়োজনে। সর্বসাধারণে নজরুলের জাতীয় কবি হয়ে বেঁচে থাকা হবে না, যদি দুঃশাসন না থাকে। কেন, নজরুলের তো আরও অনেক মাত্রা আছে, যেমন ধর্ম, ভক্তি, তার বেলায় সে কি টিকে থাকবে না?

ধর্ম-মাত্রার ভিতরে নজরুলের বেঁচে থাকাটা আপেক্ষিক ও শর্তসাপেক্ষ। দুঃশাসন দূর হয়ে গেলে মানুষের মৌলিক চাওয়াগুলোর সামনে দাড়িয়ে থাকা জিজ্ঞাসার চিহ্নগুলোও অপসারিত হয়ে যাবে। মানুষের সাধারণ মনস্তাত্ত্বিকতা হলো, মানুষ যদি জীবন যাপনের জন্যে উপর্যুপরি প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়, তবে সে অদৃষ্টবাদ ও ধর্মবাদের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই ধর্মের উপর থেকে আগ্রহ উবে যাওয়ার সাথে সাথে বাঙালী মেজাজ থেকে নজরুলের অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ ধর্ম হলো একটা ভিন্ন মাত্রার দুঃশাসন, যা মানুষকে পদদলিত করে হাত-পা-মুখ বেঁধে। আজকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। কাল যদি ঐ দেশ ধনে, মানে, শাসনে, শিক্ষায়, সভ্যতায় নরওয়ে অথবা সুইডেনের পর্যায়ে চলে যায়, তবে বাঙালী মননে নজরুলের অস্তিত্ব-বিলুপ্তির ঘণ্টাধ্বনি শুনে আমার শুধু দুখুমিঞার কথাই মনে হবে। এমন মনে হলেও কিছু করার নেই- কারণ এটাই বাঙালী-বাস্তবতা।

বহুবিবাহের সমঝদার একজন কুস্বামী তার সব স্ত্রীগনকেই স্বীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখে না বা রাখতে চায় না। স্ত্রীগণের ভিতরে একটা জটিল রাজনীতি পয়দা করে সে যথেষ্ট ফায়দা তুলতে পারঙ্গম। একজন কুশাসকও ঐ কুস্বামীর মতন ধর্মবাদী আর লালনবাদীদের দুটি ভিন্ন স্বত্তা নিয়ে জটিল এক জিলাপী জাতীয় রাজনীতির প্যাচ মেরে দুঃশাসনের নাটবল্টু টাইট দিয়ে ক্ষমতার আরশ মজবুত থেকে মজবুততর করে তোলে। তবে তাদের এই দক্ষতা যে কোন পলিগেমী স্বামীর থেকে ঢের ঢের বুনিয়াদী। মৌলবাদ যখন বেশী বারাবাড়ি শুরু করে দেয়, দুঃশাসক লালন-রবি-নজরুল ঘরাণার তোয়াজ করতে শুরু করে দেয়। আবার যখন লালন ঘরাণায় বাঙালী জাতীয়তাবাদ চ্যাগাল দেয়, তখন কুশাসক মুল্লাদের মূল্যায়নে প্রবলভাবে উৎসাহী হয়ে উঠে। ঠিক যেন বড়বৌ আর ছোটবৌয়ের গার্হস্থ্য কুটনীতি।

এরপরেও কিন্তু কথা থেকে যায়। যাদের বিদ্রোহ করার শক্তি, সাহস কোনটাই নেই, অথচ সদা নিষ্পেষিত। যারা নজরুলের ভীম রণভূমের থেকে সর্বস্ব হারানো পলাতক, যারা ধর্মীয় আচার আর কৃচ্ছ্রসাধনে বিরক্ত ও হতাশ তারা কোথায় আশ্রয় নেবে। তাদের আশ্রয় দেবার সাধ্য নেই নজরুলের। কিন্তু সেই পরাজিত মানুষদের জন্য জায়গা রয়েছে লালনের পর্ণ কুটিরে। সেখানে কোনকিছু ছাড়াই জীবন হাসে অট্টহাসি, সাথে থাকে আলেক সাই, মনের মানুষ, আচিন পাখির ভাবজগত। সেথায় আছে সাইয়ের বারামখানা, আরশি নগর, আরও কত কি! সেখানে প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা রবি ঠাকুরও যে তার ভাবগুরু লালনের মতন পরাজিত মানুষদের জন্যে শীতলা আশ্রয় বানিয়ে রেখেছেন তা কে না জানে। ধর্ম যাকে ঠকিয়েছে সেও নিজে নিজে আনন্দ-জীবনের স্বাদ নিতে শিখে ফেলে রবীন্দ্র নিলয়ে আসা যাওয়া, কাউকে তা দেখিয়ে দিতে হয়না। শুধু সহায়-সম্পদ আর অর্থ হারালে, বা দুঃশাসনের কাছে সম্মান হারালে মানুষ নিঃস্ব হয় না। জীবনের প্রতি আশা হারালে, ভালবাসা হারালে, ঈশ্বর হারালেও মানুষ পরাজিত হয়। তাই নানান প্রজাতির পরাজয়ের ঘায়ে পরাজিত মানুষদের শীতল আশ্রয় জোটে রবীন্দ্র নিকেতনে। হায় বিনা পয়সার এমন শান্তির আশ্রয় ছেড়ে কে নজরুলের ডাকে রাজা হটাবার রণভূমে গিয়ে যুদ্ধ করতে উদ্দীপিত হবে।

ধ্রুপদী জগতে রবীন্দ্রসৃষ্টি নিঃসন্দেহে আজীবন কিছু বুঝদার মানুষের প্রশংসা কুড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি দুঃশাসনের চাপে সেইসব নন্দিত রবীন্দ্রসম্ভার চয়ন করার পাত্র না তৈরি হয় সমাজে, দেশে দেশে। কুশাসক যদি মনে করে, শিল্পের জন্যে শিল্প সৃষ্টি করে মানুষকে সুকুমার বৃত্তি চর্চার সুযোগ দিয়ে আমি কি শেষে গদি হারাবো! অথবা মৌলিক প্রাপ্তিতে দেশের মানুষ খুশি হয়ে যদি মনে করে তারা পরাজয় শব্দটা জীবনের অভিধান থেকে মুছে দিয়েছে, তাই তাদের শীতলা আশ্রয়ের দরকার নেই, অথবা দেশে যদি আর কোন শকুনি দুঃশাসক না থাকে, তাহলে? তাহলে কী হবে? তাহলে কি রবীন্দ্র ও নজরুল উভয় অস্তিত্ব একপ্রকার সংকটের মুখে পড়বে না? এক রকম নিঃসন্দেহে বলা যায়- না তাদের কারোরই অস্তিত্ব সংকট দেখা দিবে না। তারা বেঁচে থাকবেন। তাদের বাঁচিয়ে রাখা হবে। শাসক তার নিজের প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রাখবে লালন, হাছন, নজরুল, রবীন্দ্রকে। কারণ দুঃশাসনের চাকা সচল রাখতে এই ঘরানার জনগণমনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দরকারি।

দক্ষ বাবুর্চি যদি জটিল কোন খাবার তৈরি করে, তবে তার সাথে সে হজমে সহায়ক নানান সালাদ, চাটনি, বোরহানি, দৈ, রাইতা, ইত্যাদি তৈরি করে, যাতে সর্বসাধারণে তার জটিল খাবার খেয়ে হজম করে শরীরে পুষ্টি লাভ করতে পারে। এখন ধরুন আপনি একজন লেখক। আপনি মিথোলজি, মিস্টিসিজম, রোমান্টিসিজম, রেয়ালিজম, সুরেয়ালিজম, হাইপার রেয়ালিজম, মডার্নিজম ইত্যাদি নানান জটিল রস মিশিয়ে এমন একটা জিনিস সৃষ্টি করলেন যা আপনার খুব অল্পসংখ্যক অডিয়েন্স আত্তীকরণ করতে পারলো। আপনি গর্বভরে বাণী দিলেন- আমি হচ্ছি লেখকদের লেখক। আলবার্ট আইনস্টাইন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- আপনি যদি আপনার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আপনার আদ্যিকালের ঠাকুরমাকে বুঝাতে ব্যর্থ হন, তবে আপনার ওই থিওরি তেমন ভাল কিছু না। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ মিথকে নিন্মস্তরের সাহিত্য উপকরণ বলে মনে করতেন। আমার মনে হয় মিথকে অনেকটা চালের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। খাদ্যপোকরণটা যখন চালের আকারে থাকে তখন সবাই সেটাকে বিনিময়, বিক্রয়, পরিবহণ ও হস্তান্তর করে, যখন তা ভাত হয়, তখন মানুষের ব্যক্তিগত খাবার প্লেটে যায়, যখন ভাত একটু পুরানো হয়, তখন তা পান্তা হয়। এই পান্তাকে যখন আর রাখা যায় না, তখন তাকে পচিয়ে মদ বানাতে হয়, যা খেয়ে মানুষ মাতলামি করে, বিভ্রান্ত হয়। মিথ হচ্ছে সেই মদ যা পানপাত্রে ঢাললে দেখতে সুন্দর, কিন্তু ফলাফলটা ততো ভাল নয়।

একজন মানুষ কখন শিল্পমুখী হয়? যখন তার মৌলিক চাহিদাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তার হাতে যখন যথেষ্ট সময় থাকে, উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে তখন সে শিল্পকর্ম কেনে, চর্চা করে ও তার জন্যে সময়ক্ষেপণ করে। তবে অসচ্ছল মানুষের শিল্পচর্চা একটা ব্যতিক্রম বটে। উল্লিখিত মৌলিক অধিকারের লিস্টিটাই দেশদেশে ভিন্ন হয়। আজও বাঙালী চলার মত একটা রাস্তা, আরোগ্য হবার মত একজন ডাক্তার, নিরাপদে থাকার মতন একজন পুলিশ, মানুষ হবার জন্যে একজন শিক্ষক, চিন্তামুক্ত থাকার জন্যে একজন নেতার জন্যে হাহাকার করে। কেমন করে সে শিল্পজগতে প্রবেশ করবে? কেমন করেই বা শিল্পের রস আস্বাদন করবে? তবে ভান করতে পারবে, শিল্পবোদ্ধার ভান। এই ভান করা মানুষের সংখ্যা আজ বেশী বাংলায়। আমি এমন অনেক মানুষের বাড়িতে ইলিয়াসের খোয়াবনামা, আর জীবনানন্দের ধুসর পাণ্ডুলিপির ইংলিশ ভার্সন দেখেছি, যাতে মনে হয়ে হয়েছে কেন গাধাকে বাঘ হবার জন্যে বাঘের চামড়া পরতে হবে! এই হচ্ছে আসল সমস্যা। যখন লেখক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি নিরবচ্ছিন্ন সংস্কার চিন্তা ও কর্ম থেকে সরে আসে, তখন এমনই হয়। তখন মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দুঃশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মানুষের সামাজিক চরিত্রে সংস্কার প্রক্রিয়া চালু রাখার কাজটা লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এই কাজ রাজা হটানো বিপ্লবের চেয়েও জরুরী ও উন্নত। একটা সর্ববঞ্চিত জাতি তার বঞ্চনা থেকে উঠে আসার জন্যে যে জিনিসটা দাবী করতে পারে আপনার কাছে, সেটা আর কিছু না, সেটা তার আবহমান কালের সামাজিক চরিত্রের নিরবচ্ছিন্ন সংস্কার। সেই সংস্কারটা হতে হবে র‍্যাশনালিজম বা কাণ্ডজ্ঞানবাদের দিকে। আপনি যদি একটা জাতির কাণ্ডজ্ঞানের উন্মেষই ঘটাতে না পারেন, তবে কিসের আপনার শিল্প-সাহিত্য, কিসের আপনার পদক-খিলাত। একবার নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটা পড়ুন, পড়ে বুঝার চেষ্টা করুন। সেখানে মাদকতায় ভরা মিথের ভাপে আপনার সেলফ-এস্টিমের বেলুনটা একেবারে আকাশ স্পর্শ করবে। এই বেলুন নিয়ে যদি আপনি বাস্তব পৃথিবীতে নেমে আসেন আপনার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, দেখবেন বেলুন ফুটো হয়ে কনডমে পরিণত হয়েছে, আর তার ভিতরে আপনি আঁটকে গেছেন। এমন আরও বহু শিল্প সৃষ্টি হয়েছে বাংলায়, যা গণমানুষের কাণ্ডজ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। এইসব রচনা এক কথায় লালন ঘরানার আশ্রয়বাদী শিল্প।

হা তবে আশা আলো যে নেই তা বলবো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলার ইতিহাসে যদি কোন সংস্কার আন্দোলন হয়ে থাকে, যদি কোন র‍্যাশনালিজম বা কাণ্ডজ্ঞানবাদের আন্দোলন দানা বেঁধে থাকে, তবে তার প্রকাশ আমরা দেখেছিলাম ২০১৩ সালের গণজাগরণ মুভমেন্টের ভিতর দিয়ে। আশাবাদের কথা এই আন্দোলনকে অভিজিৎ সহ আপারপার আরও অনেক লেখক-প্রকাশক-বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে বন্ধ করা যায়নি। এটাই গণমানুষকে কাণ্ডজ্ঞানবাদ তথা যুক্তিবাদের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে কাঙ্ক্ষিত শিল্পচেতনার দিকে নিয়ে যাবে। আগে মুরগী, পরে ডিম। আগে কাণ্ডজ্ঞান, পরে শিল্পযাত্রা। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যত লেখক বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে, তারা কম আর বেশী সবাই লালন ঘরানার আশ্রয়বাদী, যাদের দ্বারা মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে কাণ্ডজ্ঞানবাদের প্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব নয়। লালন ঘরানার একটা সুবিধা হলো, এরা ধর্মবাদীদের মতন সহিংস মাংসাশী নয়। তবু তারা সর্বগ্রাসী সম্মোহনবাদী, যা অর্ফিয়াসের বাঁশরী হয়ে ঘুম পড়িয়ে রাখতে পারে অধিকারবঞ্চিত জনগনমন।

২০১৩ সালে মূলধারার যে কাণ্ডজ্ঞানবাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা আজও শেষ হয়ে যায়নি, সেকথা আগেই বলেছি। এই আন্দোলনকে অনেকে বিভ্রান্ত করেছে, একে নিয়ে অনেকে ব্যবসা করেছে ও করছে, তবু সে তার মূল সুরটাকে হারিয়ে ফেলেনি। কিন্তু তার কোন জাতশত্রু নেই, সেকথা বলা যাবে না। তার মূল শত্রু বাংলায় প্রতিষ্ঠিত বুনিয়াদী দুঃশাসন আর এই দুঃশাসনকে টিকিয়ে রেখেছে যে সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিতন্ত্রী শক্তি, তারা। তাদের স্বার্থ এই আন্দোলনের পরিপন্থী। এখানে উগ্র মোল্লা সম্প্রদায় একটা টুলস, হাতিয়ার বা খুন-খারাবীর দিনমজুর, যাদের উদ্দীপিত করা হয় তাদেরই পবিত্র গ্রন্থ দিয়ে। তাই বলা যায়, সংস্কারবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয় দিয়ে তাদের দিনমজুরদের পরিবর্তন থেকে নিরাপদ করেছে, সাথে সাথে অসহায় লেখকদের আশ্রয় দিয়ে মানবতাবাদীদের খাতায় লিখিত নামটাকে আরও উজ্জ্বল করা গেছে। এতই যদি তোমাদের প্রগতিশীল মতাদর্শের প্রতি দরদ থাকবে, তবে কেন তাদের বাংলাদেশে রেখে এমপাওয়ার্ড করা গেল না? কেন তাদের এমব্যাসিতে আশ্রয় দেয়া গেল না? সেটাও তো একটা বিকল্প হতে পারতো।

আমাদের প্রচলিত শিল্প-সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা গনমানুষের সামাজিক চরিত্র সংস্কারের অনুকুলে নয়। বরং সামাজিক চরিত্র স্থবির হয়ে পড়ে থাকাটা অনেক বেশী লালন-চেতনার অনুগামী।  ঠিক কি কারণে রবীন্দ্র ও নজরুল চিন্তা আজও বেঁচে আছে, এমন প্রশ্নের উত্তর নিঃসন্দেহে বহুমাত্রিক। দুঃশাসনের চাকার বিন্দুমাত্র বিকৃতি না ঘটিয়ে নজরুল ও রবীন্দ্র চিন্তার বেঁচে থাকা সক্ষমতা রয়েছে। তাই দেড়’শ বছরের পুরানো রবীন্দ্র চিন্তন, আর পঁচাত্তর বছরে পুরানো নজরুল চেতনা আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বরং দিনদিন তা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। অথচ সময় বয়ে চলে গেছে বহু বহু দূর। সমাজ-সংসার, বাঙালী মনন, প্রযুক্তি চেতনা বদলেছে বিস্তর। কিন্তু একটা জিনিস বদলায়নি, তা হলো দুঃশাসনের চরিত্র। দুঃশাসন সহনশীল বাঙালীর উপরে সহস্রাব্দের জগদ্দল পাথর। সেই পাথর অত সহজে পরিত্রাণ দেয়নি, দিবেও না বাঙালীকে। রবীন্দ্র-নজরুল চেতনার সাধ্য নেই সেই জগদ্দল পাথরে আঁচড় কাটে। শাসক তাই উপজাযক হয়ে যেমন ধর্মকে রক্ষা করে, তেমনি রক্ষা করে চলে লালন ঘরানার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাই ঠিক যে কারণে রবি-নজরুলকে বাঁচিয়ে রাখার দায় শাসক অনুভব করে, অনেকটা ঠিক সেই কারণেই হুমায়ুন আজাদ-সামসুর রহমান-আহমেদ শরিফদের বেঁচে থাকাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে সে।

তাহলে আমাদের ঠিক উপায়টা কি? আমরা সবাই জানি- শিয়াল ছাড়া জঙ্গল নেই, উপায় ছাড়া সমস্যা নেই। খুব শক্ত বুনিয়াদী কাঠামো নিয়ে দুঃশাসন যে বাঙালী জাতির কাঁধে জোয়াল হয়ে চেপে বসেছে তা বুঝা যায় একটু পিছন ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকালেই। মুক্তির জন্যে আমাদের তাই প্রথম চাওয়া হতে হবে- আমরা একজন সংস্কারক চাই, একজন সংগঠক চাই, একজন শাসক চাই। কারণ সাতচল্লিশে রাজা হটানো হয়েছে, একাত্তরে রাজা হটানো হয়েছে, কিন্তু বাঙালীর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জিত হয়নি। তাই সংস্কারের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটালে যে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে তাতেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথ তৈরি হয়ে যাবে। যে পথে জন্ম নেবে একজন আদর্শ সংগঠক এবং একজন আদর্শ শাসক। অথবা এমন একজন কবি চাই, যে একজন উচ্চমার্গের সংস্কারক, যে লিখতে জানে প্রকৃত মুক্তির গান। সেই অর্থে বাংলাভূমি ভীষন অনুর্বর নিষ্ফলা, একজন সংস্কারকের জন্ম সে দিতে অপারগ। লালন ঘরানার কেউই সেই অর্থে সংস্কারক ছিলেন না, ছিলেন শীতল আশ্রয়দাতা, বা বড়জোর দুঃশাসক হটানোয় উৎসাহ দাতা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s