লিখেছেন- রওশনারা বেগম
মুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করতে আমরা অনেকেই ভুল করে ফেলি। মুক্তি মানে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার পাওয়া নয়। মুক্তি মানে শুধু শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলা নয়। মুক্তির সংজ্ঞাটি একটি সর্বাত্মক ও অর্থবহ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক নির্দেশনা দেয়। সার্বজনীন কল্যাণে আপন সৃজনশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশই মুক্তি। নারী মুক্তি আর পুরুষের মুক্তি আলাদা ভাবে কিছু নেই- পুরাটাই মানবতার মুক্তি। এক শ্রেণীর মুক্তি আরেক শ্রেণীর কষ্টের কারণ হলে সেটা প্রকৃত মুক্তি নয়। আবার একজনের প্রেমের আরেকজন প্রতারিত হলে তাকে কি প্রেমের মর্যাদা দেওয়া ঠিক? বরং এক শ্রেণীর মুক্তির উপযোগিতা থাকতে হবে আরেক শ্রেণীর কাছে। সে ক্ষেত্রে কোন একটা শ্রেণীর মুক্তি প্রচেষ্টায় সামিল হবে অন্যান্য শ্রেণীও। নারী মুক্তিও এই ধরনের সামাজিক কোষ্ঠীপাথরে যাচাই করতে হবে। অর্থাৎ পুরুষের প্রয়োজনে নারী মুক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিক গতি পেতে পারে। নারী মুক্তি সর্বজন গ্রহণ যোগ্যতা পাবে যদি তা মানব মুক্তির সাথে সংগতি ও ভারসাম্য রেখে চলতে পারে। সংঘর্ষ ও ঘৃণা বিদ্বেষের মাধ্যমে কোন একটা শ্রেণীকে প্রতিপক্ষ দাড় করিয়ে নারী মুক্তি সম্ভব নয়। এখানেই জাতিগত মুক্তি সংগ্রাম আর নারী মুক্তি সংগ্রামের ভিতরে স্পষ্ট বিভেদ রেখা দৃশ্যমান হয়।
সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রাণী কূলে কোন লৈঙ্গিক বিভেদ ছিল না। এ কথা জানতে পারি ডারউইনের জীবন বৃক্ষ থেকে। আস্তে আস্তে সেই এককোষী প্রাণী বহু কোষীতে রূপান্তরিত হয়েছে। লৈঙ্গিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। নারী ও পুরুষ এই দুই লৈঙ্গিক বিভাজনের পাশাপাশি আরও কিছু লিঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে। যা আজও আমাদের সমাজে স্বীকৃতি পায় নি। তবে সেই প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না। নারী মুক্তি নিয়েই আমার আলোচনার বিষয়। দৈহিক কাঠামোয় নারী ও পুরুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নারীর দৈহিক সৌন্দর্য নারীর প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ। পুরুষের কাছে নারীর এই সৌন্দর্যের কদর আছে তেমনি বাণিজ্যিক মূল্যও রয়েছে। আর এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার না হবার ফলে নারী মুক্তি সম্ভব নয়। তেমনি প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু সম্পদ পুরুষের মধ্যেও আছে তাহলো আগ্রাসী স্বভাব ও শারীরিক শক্তি। এই স্বভাবেরও একটা সামাজিক উপযোগিতা রয়েছে। আর এই স্বভাবের যথেচ্ছা ব্যবহারে পুরুষের মুক্তির পথটিও বন্ধ হয়ে যায়।
মানুষ জন্মেই স্বাধীন। আস্তে আস্তে তাকে সেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি করা হয়। এই বন্দি দশা যারা তৈরি করেন তারা স্বাধীনতা হনন কারী মুক্তির পথে বড় বাঁধা। যারা অন্যের স্বাধীনতা হনন করতে পারে তারা নিজেরাও স্বাধীন নয়। তারা এক ধরনের পাশবিক ও জৈবিক শক্তি ব্যবহার করে সকল মুক্তির পথ বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের পরাধীনতা নিয়ে একটা সামগ্রিক পরাধীনতার পরিবেশ তৈরি করে থাকে। এই ক্ষেত্রে সামগ্রিক মুক্তি নির্ভর করে সার্বিক সব বিষয়ে মুক্তি। শুধু নারী একার পক্ষে মুক্তি আনা সম্ভব নয়। এই যাত্রায় সকল মানুষের চেষ্টা একটা সামগ্রিক মুক্তি আসবে যার মধ্যে নারীর মুক্তিও আসবে। প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের ব্যবহার করে যদি কেহ তার নিজস্ব একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করে তাহলে সেটি হবে পশু সুলভ আচরণ। এর মাধ্যমে নিজের কোন অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না বরং শক্ত একটি জালে নিজেকে বেধে ফেলা হয়। যেমন প্রথম চমকে যাকে দেখে মুগ্ধ বলে মনে হয় দীর্ঘ যাত্রায় সেই রূপ সৌন্দর্যের মুগ্ধতা আর থাকে না। যা থাকে তা হলো সৃজনশীল কিছু গুণাবলী।
পিঞ্জর খুলে মুক্ত করো জন্ম-স্বাধীন প্রাণ
প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্যের মধ্যে একটা সার্বজনীন বোধ রয়েছে। তবে যে মানুষটি এই সৌন্দর্যটি ধারণ করেন তার মধ্যে একটা নিজস্ব স্বতন্ত্র বোধ সর্বদাই জাগ্রত থাকবে যা তার নিজস্ব ব্যক্তি স্বাধীনতার একটা অংশ। আর এখানেই আমরা নারীরা অনেকেই ভুলে যাই নিজস্ব স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা। যার ফলে নিজের শারীরিক সৌন্দর্যটি সম্পদের তালিকায় এনে ব্যবহৃত করে অধিকার আদায় কিংবা মুক্তির উপায় হিসাবে একটা অস্ত্রের মতই ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। এখানেই মুক্তির পথে একটি প্রধান বাঁধা। নানা কারণেই সৌন্দর্যের আড়ালে অর্জিত গুন উপেক্ষিত থেকে যায়। আর যাদের অনেক অর্জিত গুন রয়েছে, সামাজিক অবকাঠামোর ত্রুটির কারণেই তার সঠিক প্রয়োগ দেখা যায় না। যেমন ঘরের স্বামী তার স্ত্রীকে যে ভাবে দেখতে পছন্দ করেন স্ত্রী সেই ভাবেই নিজেকে স্বামীর কাছে উপস্থাপন করে থাকেন। এখানে নারীর নিজস্ব কোন স্বাধীনতা থাকছে না। অন্যের কাছে কি ভাল লাগে শুধু সেই দিকে বিবেচনা করে নারী তার চলন গঠন করে থাকে। এখানে নিজের কি ভাল লাগে সেই দিকটা সে একেবারেই ভুলে যায়। অন্যের ভাল লাগার উপর ভিত্তি করেই জীবনটা চালাতে থাকে। এমন কি তার নিজস্ব বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব আর থাকলো না। আর এই অবস্থায় মুক্তির পথটি বন্ধ হয়ে যায়। এই ভাবেই নারীকে অধীনস্থ করার প্রবণতা গতানুগতিক ভাবে চলে আসছে। একমাত্র শিক্ষাই নারীকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীতে পরিণত করতে পারে যা তার নিজস্ব স্বকীয়তা ধারণে সাহায্য করে থাকে। এই ক্ষেত্রে পুরুষকেই বুঝতে হবে মানবতার জন্য পুরুষের সাথে নারীর সহবস্থান দরকার। কোন একক কর্তৃত্বের মাধ্যমে সার্বিক কোন মুক্তি আসে না। সেই ক্ষেত্রে পুরুষের একক কর্তৃত্ব একটা পশ্চাৎপদও অনুন্নত সমাজের লক্ষণ।
শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেই হবে না। সেই শিক্ষার প্রায়োগিক ব্যবহার দরকার। শিক্ষিত এক নারী পারে সংসারে অর্থের যোগান দিতে। যে পরিবারে নারীরা অর্থের যোগান দেবার ক্ষমতা রাখে সেই পরিবারে নারীর সিদ্ধান্ত নেবারও ক্ষমতা তৈরি হয়। এর ফলে স্বামীর উপর অর্থনৈতিক চাপও কমে যায় এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে আসে। আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারী মুক্তির অন্যতম শর্ত। অনেক পুরুষ মানুষকে বলতে শুনেছি ”আমার বউকে দিয়ে চাকুরী করাবো না।” আর এটাই হলো নারীকে বন্দি বা পরাধীন করে রাখার একটা কৌশল। সেই ক্ষেত্রে অনেক পুরুষের যুক্তি দেখায় যে নারীর কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদের লালন পালন করা আর স্বামীর সেবা করা। সেই ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই নারী সন্তান জন্ম দেবার জন্য একা দায়ী না তাই সেই সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের উভয়ের সমান ভূমিকা থাকা উচিত।
এ মোদের শিকল পরার ছল, এ মোদের মুক্তির দুঃসাহস
একজন লেখক যখন পাঠকের চাহিদা অনুসারে লেখা শুরু করে আর পাঠক যদি কোন সৃজনশীল লেখা না নিতে পারে সেখানে লেখককে সৃজনশীলতা ত্যাগ করতে হয় পাঠকের স্বার্থে। এই ভাবেই একজন লেখক হয়ে ওঠে পাঠকের উপযুক্ত জনপ্রিয় লেখক। এর ফলে লেখাটি বাণিজ্য সাফল্য হলেও সৃজনশীলতার দিকটি উপেক্ষিত থেকে যায়। আর এখানেই লেখকের বন্ধ্যত্ব চলে আসে। এই ভাবেই জনপ্রিয় লেখক নিজেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়। ঠিক নারীর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। বাণিজ্য সাফল্যের ফলে নারী তারকা বনে গেলেও মুক্তির পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনেক নারীর পদাচরনা দেখা যায়। এতে মনে হতে পারে নারীর বিজয় চলে এসেছে। আসলে কি তাই? ভাল পরিচালকের অধীনে এসে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে। কিন্তু দেখা যায় পরিচালক অনেক ক্ষেত্রে বাজারে সাফল্যের দিকে বেশী নজর দিয়ে থাকে। এতে নারীর সৃজনশীলতার জায়গা উপেক্ষিত থেকে যায়। আস্তে আস্তে আরেক ধরনের পরাধীনতার জালে বন্দি হয়।
লিঙ্গ ভিত্তিক কোন সংগঠন সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা পায় না। আমরা যারা নারীবাদী ভেবে নারীর অধিকার নিয়ে অনেক ধরনের কথা বলে থাকি সেখানে আমাদের মনে রাখতে হবে নারীর পৃথক কোন অবস্থান সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। নারী পুরুষের সহবস্থান ও সমান অধিকারের মাধ্যমেই সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। একজনের অধিকার খর্ব করে অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না। নারীর প্রতিপক্ষ তৈরি করে কেহ যদি নারীর অধিকারের কথা ভাবেন তাহলে সেই অধিকার কখনো সার্বজনীন রূপ পারে না। অর্থাৎ মানবতা বিঘ্ন হবে। পুরুষকে বুঝতে হবে নারীর স্বাধীনতার মধ্যে পুরুষেরও স্বাধীনতা।
নারীর স্বাধীনতার স্বপক্ষে পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এটি বিচ্ছিন্ন কোন একক নারীর ব্যাপার নয়। এটি সামগ্রিক মানবিক ব্যাপার। যেমন কোন এক নারীবাদী লেখক লিখেছিলেন ” আমি বসে আছি। হঠাৎ দেখি একটা তেলাপোকা আমার পা বেয়ে উপরের দিকে বেয়ে উঠছে। তেলাপোকাটি ধরে দেখতে পেলাম এটি একটি পুরুষ তেলাপোকা।” এখানে নারীবাদী লেখক পুরুষকে আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পুরুষের আগ্রাসী মনোভাব তো এতে কমবে না। বরং এতে বিদ্বেষ বাড়ানো হলো। এটা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন সহায়ক হবে না। যে নারীর স্বাধীনতা দরকার তা শুধু সেই নারীর কর্মকাণ্ডের উপরই নির্ভর করে না। প্রতিপক্ষের কাজ কামের উপরও এই স্বাধীনতা নির্ভর করছে। নারী ও পুরুষের পৃথক কোন মুক্তি আসতে পারে না। সকলকে নিয়েই সত্যিকারের মুক্তি আসে। একজনের মুক্তি আরেক জনের প্রতিপক্ষ হয়ে কাজ করে তাহলে সেটি কোন মুক্তি নয়। পুরুষদের বুঝতে হবে নারীর স্বাধীনতা দরকার পুরুষের স্বার্থেই। তবেই হবে প্রকৃত মুক্তি। আর এই মুক্তির ফলাফল সর্বক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে। এই কারণে নির্দিষ্ট কোন লিঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ না করে সকল লিঙ্গের সহাবস্থান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে পারে। তাই যে যেখানে আছে সেই অবস্থানে থেকেই সঠিক দায়িত্বপূর্ণ কাজটি করে যাওয়াই উত্তম। পুরুষের দায়িত্ব হলো আগ্রাসী মনোভব কমিয়ে নারীর স্বাধীনতার পিছনে অবদান রাখা উচিত মানবতার স্বার্থে।
দারুণ লিখছেন
LikeLike