ইচ্ছেঘুড়ির বাউল- ২


khali

লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

 

নদীর বালুচরে সারি সারি নৌকা। কোনটা উপুড় করা, কোনটা চিত করা, কোনটা বা কাত করা। সুতোররা কাজ করছে একমনে- কেউ করাত চালাচ্ছে, কেউ শিরিশ মারছে, কেউ বা আলকাতরা লাগাচ্ছে তক্তায়। আলকাতরার গন্ধে ময়ময় চারদিক। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একপাশে চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছে গায়েন, কেনা গায়েন। মাথা ভরা তার সাদা খোঁচা খোঁচা চুল, মুখে ধবধবে সাদা খাটো দাড়ি, খালি পা, শতছিন্ন অমলিন পিরহানের ভিতর দিয়ে কৃশ শরীরটা দেখা যায়। হাতে ধরা তার একটা দোতারা। কেনা গায়েনের মতন আরেক মলিন অস্তিত্ব এই আমার গাঁ। এই গাঁয়ের কাদা-মাটি-বালুর সাথে যে সুতোয় বাঁধা আছে কেনা গায়েনের নাম, ঠিক সেই বিনীসুতোর বাঁধনও আমাকে কিভাবে জানি টেনে নিয়ে হাজির করে সেই গাঁয়ের বালুচরে প্রতিবার। প্রতিবারই দেশে এসে সেই টানে ছুটে আসি আমার প্রিয় বালুচরে।

আকাশে মেঘ ছিল, কিন্তু বৃষ্টি ছিল না সেদিন। ঠাণ্ডা ছায়ার ভিতর দিয়ে হাটতে হাটতে শেষে বসে পড়লাম গায়েনের পাশে, বুনো গাছের শিকড়ের আসনে। গান থেমে গেল।
-থামলে কেন গায়েন? ভালই তো গাচ্ছিলে। গাও না।
শুকনো মুখে পরিচিত সলজ্জ হাসি গায়েনের। আবার শুরু হলো গান।

আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মানুষ যেরে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
বেড়াই ঘুরে। আমি কোথায় পাবো……

image003

একটার পর একটা গেয়ে চলেছে গায়েন। ক্লান্তিহীন শরীরে একখানা মলিন মুখ তবু এক টুকরো হাসি ধরে রেখেছে প্রাণপণে। নিজেকে কিঞ্চিত অপরাধী মনে হলো। দুপুর গড়িয়ে গেছে, আহারে বেচারার হয়তো সকাল থেকে কিছু খাওয়াই হয়নি। এতটা সময় ধরে কি সুধাই না ঢাললো সে সবার কানে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধাওয়া বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশ চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
-খাওয়া দাওয়া কিছু হইছে?
-ওই সুতোররা মনে হলে কখনও দেয়, না হলে দেয় না। এভাবেই চলে, চইলবে। উপরওলা এক সময় জুটায় দেয়।
গায়েনের কথা শুনে আমার বাউল গানের মুগ্ধতা অনেকটা আত্মধিক্কারে রূপ নিল।
পকেট থেকে পাঁচ’শ টাকার একটা নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- এই টাকাটা তুমি রাখো। তোমার অসুবিদধের সময় কাজে লাগবে।
দেহে ছোট্ট একটা কাঁপন উঠলো তার। মুখের রঙ গেল পালটে। ভাবলাম, হয়তো অপমান বোধ করেছে। বাউল গানে অভ্যাস্ত ঠোটজোড়া কেঁপে উঠলো যেন।
-সেখের পো, এতবড় টাকা আমার বাপের জনমে আমি হাতে করিনি। করতিও চাইনে আর। আমার ওই পেটের জন্যি দুটো দানার জোগাড় হলেই খুশি। যেহানে রাইত, সেহানেই কাইত। আমার টাকা লাগবে না।
মোটা চালের ভাত আর ডাল এলো গায়েনের জন্যে। টাকাটা নিলো না গায়েন। দেখলাম, তখনও তার মুখে লেগে রয়েছে সেই সন্তুষ্টির টুকরো হাসিটা। বসে বসে খাওয়াটা দেখলাম তার। খাওয়ার পর আবার গান ধরলো গায়েন।

মহাভাবের মানুষ যে জনা
দেখলে যায়রে চেনা।
ও তার আঁখি দুটি ছলছল,
মুখে মৃদুহাসির পতন হয় না
দেখলে যায়রে চেনা……
ও তার কামনদীতে চর পড়েছে,
প্রেম নদীতে জল ধরে না।
দেখলে যায়রে চেনা………

োপো

তন্ময় হয়ে শুনছি আর ভাবছি- সে কি মহাভাবের মানুষ, আমি কি একজন ভাবের মানুষের সামনে বসে আছি? নির্ভেজাল ভাব দিয়ে কি জীবন চলে?
হঠাত চমকে দিয়ে গান থেমে গেল গায়েনের।
-তোমার হাতে তো সময় আছে, চলো না ওই চরের ওপারে এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
রাজী হয়ে বললাম- চলো।
গায়েনের সাথে হাটতে হাটতে চলে এলাম চরের ওপারে। একটা ছাপড়া ঘর, সেই ঘরে সে কাশি দিয়ে ঢুকে পড়লো আমাকে নিয়ে। আমার হয়তো অবাক হওয়ার আরো বাকী ছিল। দেখলাম- এক অশীতিপর বৃদ্ধ ঘরের মেঝেয় বসে তার বৃদ্ধার পায়ে ওষুধ লাগচ্ছে, সারা পায়ে যার দগদগে বিষাক্ত ঘা।
আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গায়েন বুড়োর হাতে গুজে দিয়ে বললো- যাই বাবা, যাই মা। আবার আসবোনে সময় হলি।
চোখ ছাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়া পানি সে সতর্ক হাতে লুকালো যেন।
তড়িঘড়ি করে ঘরের বাইরে এসে গায়েন আমর হাত চেপে ধরে বললো- সেখের পো, তুমার কাছে আমি বড় ঋণী হয়ে রইলাম গো, চিরঋণী। অরা আমার কেউ না, ওগের কষ্টে আমার বুক ভাঙ্গে। তবু তুমার কথাই ঠিক- শুধু ভাব দিয়ে কি জীবন চলে? চলে না সেখের পো, চলে না। তুমি সুরের পাগল। যাই, আমার দিন ফুরায়। আবার কোন দিন দেখা হবিনে, কোন সুরের হাটে।

আমায় কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেল গায়েন। আমিও চলতে থাকি আমার পথে। চলতে চলতে ভাবছি, আমার মনের কথা তার কাছে পৌছাল কেমনে? সাধারন মানুষের অসাধারন আবেগ দেখে অবাক হলাম, হলাম হতবাক। কেনা গায়েন সাধারনের বেশে মহাভাবের মানুষ। সে অন্তর্যামীও। মানুষের মনের গহণে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো আলোতে বেরিয়ে আনার দক্ষতাও আছে তার। ভাবলাম, বুঝলাম- সে নতুন যুগের নতুন বাউল, ঠিক আগের মতন না। শুধু ভাবে তার জীবন চলে না। চলা উচিতও না। রবিঠাকুরের ডাকঘর গল্পের ছোট রুগ্ন ছেলেটার সাধ হয়েছিল দৈওয়ালা হবার। ইচ্ছে করেছিল ‘দৈ রাখবেন দৈ, ভাল দৈ আছে’ বলে হাক ছেড়ে ছেড়ে পাহাড়ের রাস্তা ধরে হারিয়ে যাবার। বাউলকে দেখে আমারও ইচ্ছা জেগেছে মনে, হাতে দোতারা নিয়ে গান গেতে গেতে নদীর গা ঘেষে ছোট্ট চেনা রাস্তা ধরে হারিয়ে যাব একদিন। আঙ্গুলে থাকবে সুরেলা তার, আর মুখে থাকবে কোন অচেনা কবির প্রিয় সুর।

মন তোর সন্ধ্যে হলো
দিন ফুরোল ভেবে দেখলি নে।
তোর হাতে পায়ে দেখলি বান্ধন,
খোলা মন তো দেখলি নে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s