লিখেছেন- রাজন সরকার
খুব ছোট বেলা থেকেই বাংলা লেখা হাতের কাছে যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম তা সে চানাচুরের ঠোঙাই হোক বা শাড়ি লুঙির ভাজের সাথে থাকা পুরাতন খবরের কাগজই হোক। ক্লাসের বইয়ের বাহিরে যা পাওয়া যায় তাই গপাগপ গিলে ফেলায় যেন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই ছোট বেলাকার কথা তবুও মনে পড়ে, একবার বেড়াতে গিয়ে জীবনে প্রথম একটা ছোট্ট কবিতার বই হাতে পেয়ে ছিলাম। এতোদিনে সেখানে কি কবিতা ছিল, কার লেখা ছিল বা কি বই কিছুই মনে নেই, তবে এইটুকু মনে আছে অসম্ভব ভাল লেগেছিল বইটা।
তারপর মন মাতানো স্মৃতি ছন্দমালা, গোপাল ভাঁড়, আধুনিক বাংলা গান, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গল্প, দশরথ রাজার কাহিনী, কোরানের কথা, হাদিসের কথা, মকছেদুল মোমেনিন, বিষাদ সিন্ধু, নিয়ামুল কোরান এমনি করেই যেন গ্রামের পথ পেরিয়ে বড় রাস্তা, তারপর পাকা সড়ক তারপর আরো বড়, আরো বড়! এ পথ কোন কোন সীমাহীনের পথে মিশেছে তার খবর কি আর আমি জানি! যত পড়ি ততই নতুন নতুন আরো ভাল ভাল বইয়ের সন্ধান মিলে যায়। এক পথের শেষ হয়না, আর এক পথের দিশা মিলে যায়।
এমনি পড়তে পড়তেই বিভিন্ন আলোচনায়, খবরের কাগজে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার কথা শুনেছিলাম। আমার বাড়ি পালানো জীবনের কত সময় কোথায় থেকেছি তার হিসেব নেই। একবার এক মেসে যেখানে আমিই ছিলাম সবার জুনিয়র, সেখানেও শেষের কবিতার প্রশংসা শুনেলাম। একটু বিস্ময় জাগল মনে, তারপর একদিন বইটা কিনে পড়েও ফেললাম। মনে হল দূর! এ আবার একটা বই হল নাকি! যথারীতি বইটার অস্তিত্বের কথা ভুলেও গেলাম।
বেশ কিছুদিন পর আবার কোথায় যেন আলোচনা শুনলাম সেই শেষের কবিতা নিয়ে। পুনরায় বইটা হাতে নিলাম, গভীর মনোযোগ দিয়ে আবার পড়তে শুরু করলাম। এবার প্রথম পাতাতেই আবিষ্কার করলাম বিস্ময়! যতই পড়ি ততই মনেহয় অপার বিস্ময়!! কিছুতেই ঘোর কাটতে চায়না। রবীন্দ্রনাথের মত পাকা চুলদাড়িতে ভরপুর কিম্ভুতকিমাকার বৃদ্ধের পক্ষে কি করে এতোটা রোমান্টিক হওয়া সম্ভব! প্রতিটা লাইনে, প্রতিটা কথায় সে কি এক জাদু! প্রবল আবেগ, অসম্ভব ভালবাসা! একবার পড়ি, দুবার পড়ি, রসের ঝর্ণাধারা যেন নিরবধি বয়েই চলে, কিছুতেই শেষ হতে চায়না। যতবার পড়ি ততই যেন নতুন করে এর থেকে রস বের হতে থাকে, ততই নতুন লাগে।
বাংলা সাহিত্যের ভুবনে অজস্র বই আছে, অজস্র বই পড়েওছি, প্রতি বছর নতুন নতুন আরো অজস্র বই বের হচ্ছে, হবেও। তবুও মাঝেমধ্যেই হৃদয়ের মধ্যে “শেষের কবিতা” যে দোলা দেয় তা আর অন্য কোন উপন্যাসে নয়।
বউ আমায় চিরদিন খোঁচা দেয় আমি নাকি খোঁট্টার দেশের মানুষ, আমার মধ্যে যুক্তি আর বাস্তবতা ছাড়া আবেগ অনুভূতির কিচ্ছু নেই।বাংলা সিনেমার নায়কদের মত বিশ পঞ্চাশটা ভিলেনের সাথে যুদ্ধ করে, আর “এক জীবনে ভালবেসে মিটেনা আশা, হাজার জীবন দাওনা আমায়, লক্ষ জীবন দাও” জাতীয় গান যদি আমার না আসে তাহলে দোষ স্বীকার করে মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর উপাই কি!
রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে, কিছুতেই তার আর তুলনা খুঁজে পাইনা। রবীন্দ্রনাথ যে চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখতে শিখিয়েছেন তা ভালবাসাময়, মাটির পৃথিবী তবু স্বর্গময়। এক রবীন্দ্রনাথের জন্যই অত্যাধুনিক ইউরোপীয় নাগরিক হওয়া সত্বেও গর্ব ভরে বলতে ইচ্ছা করে “আমি বাঙালী”। দুনিয়া জুড়ে বাঙালীর বদনাম সর্বত্রই ধর্মান্ধ, হতদরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্থ তবুও দুরের আকাশে একটি রবি আলো দেয় ভাবতে ভাল লাগে আমি বাঙালী!
নির্জন ছাদে প্রিয়তমার হাতে হাত চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছা করে
“ছাদের উপর নিরবে বহিয়ো ওগো দক্ষিণ হাওয়া,
যে নিমিষে হবে প্রিয়সীর সাথে চারি চক্ষুতে চাওয়া”।
অথবা
আমরা সেথায় যাব, যেথায় যায়নি নেয়ে সাহস করি।
ডোবে যদি তো ডুবিনা কেন, ডুবুক তরী, ডুবুক সবি।
বুড়া হতে চললাম, মনের মধ্যে থেকে তবুও সেই জড়তা, সেই সঙ্কোচটাকে কিছুতেই তাড়ানো গেলনা। আজও প্রিয়তমার চোখে শুধু নিরবে চেয়েই থাকি, কিছুই বলা হলনা। সময় চলে যাচ্ছে এরমধ্যে হয়তো নীচের কথা গুলোই বলবার সময় এসে যাবে। তবুও এই খোট্টার দেশের মানুষের মরু ধুষর বুকের অনেক গভিরে একটা ছোট্ট স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা নিরবে বয়ে চলেছে তা বোধহয় অনাবিষ্কৃতই থেকে যাবে।
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু’সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।