যে রাতে সে ধরা দিয়েছিল


Akbar

লিখেছেন- আকবার হোসেইন

মনে হয় ১৯৭৯/৮০ সালের কথা আমি জামালপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামে ঘুমিয়ে ছিলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাইরে এসে দেখলাম অন্ধকার নিশুতি রাত আর থোকা থোকা জোনাকি পোকার মেলা। কোথাও বাঁশের ঝাড়ে পাখীর ডানার ঝাপটা আর দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক। গ্রাম প্রান্তে তাকিয়ে দেখলাম একটি যাত্রীবাহী রেলগাড়ি হুহু করে অন্ধকারকে ভেদ করে এগিয়ে চলেছে। সারি সারি বগীর ভিতরে যাত্রীরা সবাই হয়তোবা সুষুপ্তিতে মগ্ন আর এই গভীর রাতে কেউ জেগেই বা থাকবে কেন। বগীগুলির ভিতর থেকে হলুদ ম্রিয়মাণ আলো অন্ধকারকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দ্রুত অপস্রিয়মাণ।

image005

চেতনার বহুরঙ। চেতনা সর্বগ্রাসী , কখনওবা ব্যাখ্যাতীত।

সেই ছেলেবেলায় ৫ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে রেল সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম রেলগাড়ি দেখেছিলাম। কর্ণবিদারী হুইসেল বাজিয়ে রেলগাড়ি উধাও হয়ে গেলে বাবা বলেছিলেন, লোহার পাতে কান পেতে দেখ কেমন লাগে? আমি কান পেতেছিলাম আর শুনেছিলাম বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা ধীরে ধীরে মিশে যাওয়া শব্দ। কিছু একটা উদাস করা সূর ছিল সেখানে যা আজো ভুলতে পারিনি। রেলগাড়ির গতির সাথে চলে যাওয়া, মিশে যাওয়া আর চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার একটা যোগ আছে। সেদিন রাতেও অনুভব করেছিলাম খণ্ড খণ্ড জীবনের মাঝে এক অখণ্ডের যোগ। আমার জীবন, রেলগাড়িতে সুপ্তিতে মগ্ন যাত্রীদের জীবন, গ্রামে ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের জীবন সব যেন আলাদা হয়েও এক অদেখা সুতোয় গাঁথা।

 

ট্রেনটা অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেলে দিগন্তে অগুনতি তারা, অনেক উঁচুতে গোল ঢাকনার মতো আকাশ আর রাতের অগ্রসরমান প্রহর ছাড়া আর কিছু রইলনা। পাশ দিয়ে জ্বলজ্বলে আগুণের মতো চোখ তুলে তাকিয়ে একটা নিশাচর প্রাণী ত্রস্থ পায়ে চলে গেল। অন্ধকারে অনুভবের আলোটা বুকের ভিতরে কেমন যেন ভারী হয়ে জ্বলতে থাকে। যা ছিল, যা নেই আর যা হবে সব এক সারিতে ট্রেনের মতো হেলেদুলে ঘিরে ঘিরে নেচে বেড়ায়। সব কিছুর চিত্রকল্প যেন বিমূর্ত হয়ে উঠে আর নিজেকে নিজের ভিতর থাকতে দেয়না। প্রকৃতি অনেক সময় নববধূর মতো নিজেকে সহজে প্রকাশ করতে চায়না। তাকে নরম অনুভূতির আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করতে হয়। সেই নিশুতি রাতের কথা ভাবি আর মনে হয় আলোয় আঁধারে মেশানো তার কোমল রূপ যাকে আমি ঘুমিয়ে থেকে ভুলে ছিলাম সে যেন সেদিন ঘোমটা খুলে আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিল। প্রকৃতির অতি বিশাল হৃদয় ঘরের কোনে থাকেনা।

image001

নিসর্গ কখনও ধরা দেয় অপরিচয়ের বেশে, অথচ এইসব কত চেনাজানা

আমি নিঃশব্দে ঘরে ফিরে এসে দেখলাম আমার যুবতী স্ত্রী আর দেড় বছরের শিশু কন্যাটি সুষুপ্তিতে মগ্ন। বাইরে বৃহতের বড় অজানা আকর্ষণ ছিল তবু ফিরে এসেছিলাম। আড়াই হাজার বছর আগে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে সুন্দরী স্ত্রী আর শিশু পুত্রের মায়াকে ত্যাগ করে ঘর ছেড়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ নির্বাণের কুয়াশার আহ্বানে। তিনি কি পেয়েছিলেন আর আমি কি পেলাম আমরা দুজনই কি জানতে পেরেছি?

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s