লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা
গল্প দিয়েই শুরু করি, যদিও সবার জানা কাহিনীটা। এক রাজা বড় এক দিঘী খুড়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে প্রজাদের বলে দিলেন- আগামীকাল সকালে যেন দেখি, এই দিঘী দুধে ভরে গেছে। অর্থাৎ রাত পোহাবার আগে আগে প্রত্যেক প্রজাকে এক কলস করে দুধ দিঘীতে ঢালতে হবে- এমনই আদেশ। রাজা বাদশারা তো আদেশ দিয়েই ঘুমিয়ে গেলেন। প্রজাদের মাথায় সব একই চিন্তা। তাদের চিন্তা কীভাবে এক কলস দুধ বাঁচানো যায়। তারা প্রায় সবাই পৃথক পৃথকভাবে একই জিনিসই স্থির ভেবে বসে থাকলো- আমি একা একজন প্রজা দীঘিতে দুধ না ঢেলে এক কলস পানি ঢাললেও চলবে, এত প্রজা, এত লোক, আমার এক কলস পানির জন্যে রাজার দীঘি দুধ দিয়ে ভরানো আটকাবে না। আশ্চর্যজনকভাবে সব প্রজা লুকিয়ে লুকিয়ে এক কলস করে পানি ফেলে আসলো দীঘিতে। রাজা সকালে একটা ভরা দীঘি পেলেন, তবে দুধ ভরা নয় পানি ভরা। এই হচ্ছে অশুভ চক্রের একটা রূপকথা জগতের গল্প। রাজা যদি নিজ লোক লস্কর নিয়ে নিজ হাতে এক কলস দুধ ফেলে দুধ ভরাটের কাজটার ফিতে কেটে সেখানে দাড়িয়ে থেকে বলতেন- প্রজারা, আমি এখানে দাড়ালাম। তোমরা সবাই বাড়ি থেকে এক এক কলস দুধ এনে আমার সামনে এই দীঘিতে ফেলবে। এমন করলে রাজা হয়তো একটা দুধে ভরা দীঘি দেখতে পেতেন।
বৈচিত্রে জীবন বাঁচে, পরিবর্তনে বাঁচে সমাজ
গল্প বাদে, বাস্তব পৃথিবীতেও এমন অশুভ চক্রের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তেমন কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক। মেয়েদের বেশী লেখাপড়ার দরকার নেই, বেশী খাওয়াদাওয়ার দরকার নেই, বেশী বাইরে বেরুবার দরকার নেই- এমন সংস্কৃতি আমাদের সমাজ শাসন করেছে বহুদিন, এখনও করছে অনেকটা। মেয়েরা এই রীতির সবচেয়ে বড় পাহারাদার। মায়েরা তাদের সন্তানদের মধ্যে থেকে মেয়েদের আলাদা করে এইসব নিয়ম-রীতি প্রয়োগ করেছেন অগ্রণী হয়ে। সেইসব মেয়ে সন্তানেরা যখন বড় হয়েছে, তারাও তাদের মেয়েদের উপরে একই রীতি প্রয়োগ করেছে। যার ফলাফল আমরা আজও পাচ্ছি। আজকের দিনে আমরা যে কজন স্বাস্থ্যবতী, উঁচা-লম্বা, সুশিক্ষিত নারী দেখি, তা দেশের মোট নারী জনসংখ্যার শতকরা কতভাগ, ভাবলে হতাশই হতে হবে। অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, তবে ধীরে।
সব হাত এক হলে নতুন সূর্য্য উঠে
আরও আছে। আমাদের সমাজের দম্পতিরা বাবা-মা হলে, আর নিজেদের সেই সন্তান একটু বড় হলে তারা নিজেদের কথা বেমালুম ভুলে যান। তারা ভাবতে শুরু করেন এখন এদেরই সময়, আমরা আর কদিন। নিজেদের সখ, আহ্লাদ, স্বাধীন চিন্তা-চেতনা, হবি, সব জলাঞ্জলি দিয়ে তারা সন্তানের একমাত্র ভবিষ্যৎ নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। অথচ সখ, আহ্লাদ, হবি ইত্যাদির ভিতরে রয়েছে সৃজনশীলতা, নতুন সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা। এইসব দম্পতির সন্তানেরা যখন বাবা-মা হন, তখন তারা তাদের পিতা-মাতাকেই অনুসরণ করে চলেন। এই হলো আরেক অশুভ চক্রের পর্যায়ক্রমিক ঘূর্ণন। এই চক্রের ঘূর্ণিতে পড়ে আমাদের সমাজ রাষ্ট্র কী হারিয়েছে, আর কী হারাচ্ছে তা কি আমরা সচেতনভাবে একবারও ভেবেছি?
এবার নিজের জীবনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ানে আসি। তখন সবেমাত্র ফেসবুক নামক আজব এক জিনিসের আবির্ভাব ঘটেছে পূব আকাশে ভোরের সূর্য্যের মতন। এই অধমও একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে পরম কৌতূহলে। দিনে রাতে ভাল ভাল পোস্ট পাই। পোস্ট পাই নানান রথী-মহারথীদের লেখা পোস্ট- সমাজ, সংসার, রাজনীতি, বিশ্বনীতির নানান সমালোচনামুখর জ্বালাময়ী রচনা। একদিন বেশ আশা নিয়ে এইসব মহাজনদের কাছে ইনবক্স করি, মেসেজ পাঠাই- ভাই, আসেন আমরা এক জায়গায় বসি, একত্রিত হই, আলোচনা করি, তারপরে ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নেই কি করা যায়, কী আমাদের করার আছে। ভাবলে এখনও অবাক লাগে, তিন হালি মহাজনের ভিতরে পাঁচজন আমাকে ব্লক করে দেয়। তিনজন মেসেজের জবাবে লেখে- আমরা আর কদিন। আমাদের লেখার দরকার লিখে দিলাম, জানিয়ে দিয়ে গেলাম বিরাট বিরাট অসংগতিগুলো। কেউ না কেউ এইসব অনাচার শুধরানোর দায়িত্ব নিবেই। বাকীরা আমার মেসেজে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না। ভাল লরে লক্ষ করুন, যারা আমার বার্তার উত্তর দিয়েছিলেন, তারা কী বলেছিলেন। ভাল করে খেয়াল করে দেখুন তো, গল্পে বর্ণীত রাজার প্রজারা সারারাত ধরে যা যা ভেবেছিল, যা যা করেছিল, তার সাথে আমাদের এই মহাজনদের কথার কোন মিল পান কিনা! রাজার দীঘি কি দুধে ভরেছিল? আমাদের সমাজ-সংসার থেকে কি অনাচার দূর হবে?
দৃপ্ত কণ্ঠ আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে প্রতিজ্ঞা প্রাণ পায়
আমরা যদি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতিহীনতাকে চিহ্নিত করতে পারি এবং তাই নিয়ে একটা রচনা লিখে ইথারে ছেড়ে দিয়ে ভাবি- এই রচনা পড়ে কেউ না কেউ সামাজিক অশুভ চক্র ভেঙ্গে ফেলে আমাদের মুক্তি দিবে, তাহলে সেটা হবে চরম ভুল ও বোকামি। কারণ আমি লেখক হয়ে যে সিকি কাজ করে দায়মুক্ত হলাম আমার শত শত পাঠকও সেইভাবে রচনাটা পড়েই তার বাকী সিকিভাগ দায় শেষ করবে। বাকী আধুলি ভাগ কাজ কোন দিনই সমাপ্ত হবে না। সুতারং, সবচেয়ে উত্তম কাজ হবে- সমালোচনাকারীকে শুরু করে দেখাতে হবে কিভাবে সাইকেল অব ইভিল বা অশুভ চক্রের বৃত্তটাকে ভাঙতে হয়। তখন দেখা যাবে শত সহস্র পাঠক এসে বাকী কাজ শেষ করে দিচ্ছে। এছাড়া আর কোন পথ আছে কিনা জানি না।
গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, গল্প দিয়েই শেষ করি। এক লোক একদা যখন নবী মোহাম্মদের কাছে সপুত্র এসে নিজের ছেলের অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস দূরিকরণে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল, তখন কী করেছিলেন নবী। তিনি নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে, দুইদিন পরে নাবালক ছেলেটাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, সমালোচনা করেছিলেন মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারে। তাই আমরা যতই ফেসবুকের পাতায় বিপ্লব, সংগ্রাম, আন্দোলন করি না কেন, যদি “আপনি আঁচরি ধর্ম অপরে শিখাইও” এই নন্দন তত্ত্বটির শরণ না লই, তবে আমাদের অবস্থা ঐ অসহায় রাজার মতনই হবে, যে একদা একটা দুধে ভরা দীঘির স্বপ্ন দেখত।