লিখেছেন- রওশনারা বেগম
আমার ঘরের দরজা প্রায় সময় খোলা থাকে। আমি জানি আমার ঘরের দরজা খুলে কেউ কোন দিন ও প্রবেশ করবে না যদি করে থাকে তাহলে সে ব্যক্তি স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে থাকবে। এই ব্যক্তি স্বাধীনতা লঙ্ঘনের কি অপরাধ তা সবার জানা। তাই ভুলেও এই কাজটি কখনো কেউ করে না। এখানকার ব্যক্তি স্বাধীনতা যে কত সুন্দর ভাবে সুরক্ষিত তা কানাডায় না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়।
সেই এক যুগেরও অনেক আগে কালো রঙের কানাডার পাসপোর্টটি গ্রহণ করেছিলাম। পাসপোর্টটির ভিতরের পাতা গুলোতে ম্যাপেল গাছের পাতার ছাপ। আজ এই এই পাসপোর্টের পাতাগুলো উল্টিয়ে পালটিয়ে নানান কথা ভাবছি। আমি কি সত্যিকারের কানাডিয়ান হতে পেরেছি? কানাডার মানবিক মূল্যবোধকে মনে প্রাণে আমি কতটা ধারণ করতে পেরেছি? কানাডার মূল স্রোতের চিন্তা ভাবনার সাথে কি কোন বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে? আর এই সমাজের মূল স্রোতটি কি? তা কি জানা হয়েছে? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে। ঠিক এই সময়ে আমার অপর হাতে আরেকটি পাসপোর্ট। সবুজ কালারে এই পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে আমি ভাবতে থাকি আমি কি চীর সবুজ যৌবনের প্রতীক হতে পেরেছি? এই পাসপোর্টটি আমার জন্ম ভূমির প্রবেশ দ্বার। আমি বাঙ্গালী। বাংলাদেশের মানুষগুলো নিয়ে ভাবি। বাংলা খাবার পছন্দ করি। বাংলার শাড়ি আজও আমার একটি প্রিয় পোশাক। বাংলার নারীর দুঃখ বুঝি। বাংলার সংখ্যা লঘুদের কষ্ট বুঝি। খেটে খাওয়া মানুষের শ্রমকে অনুভব করি। গ্রামের সহজ সরল মানুষের আবেগের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পারি। তাহলে কেন আমি বাঙ্গালী নই?
বিশ্ব-নাগরিকের ধারণা পৃথিবীর কয়টা মানুষ ধারণ করে!!
আমি সেই বাংলাকে অনুভব করি যে বাংলা লালনকে ধারণ করতে পেরেছিল, যে বাংলা রবি ঠাকুরের কাব্যকে অন্তরে লালন করতে পেরেছিল, যে বাংলা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীন মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই বাংলাকে আজ ও আমি মনে প্রাণে লালন করি। কিন্তু আজ সেখানকার বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে বেড়াতে গিলেও নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকা লাগে। যে দ্বারটি আগে খোলা রাখা যেত তা আজ বন্ধ হয়ে গেছে। যে বারান্দা উন্মুক্ত ছিল গ্রিল দিয়ে চারিদিকে তা আটকিয়ে রাখা হয়েছে। কেন আজ এত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে? জন জীবনের কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই। কেন এই নিরাপত্তাহীনতা দিনে দিনে বেড়েই চলছে? সেখানে বাড়ির দেওয়াল আরও উঁচু করা হচ্ছে। কোন কাক পক্ষীও যেন প্রবেশ করতে না পারে। সর্বত্রই মনের মধ্যে একটা ভয় আতংক কাজ করে। চোরের ভয়, মেরে ফেলার ভয়, ধর্ষণের ভয়- এত সব ভয় নিয়ে কি ভাবে মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে? মানুষ ক্রমান্নয়ে অসুস্থ রুগী হয়ে দুর্গে আশ্রয় নিচ্ছে।
নিজের নিরাপত্তা বেষ্টনী বানালেই সমস্যা সমাধান হবে না।এই অবস্থার জন্য কারা দায়ী? কেউ বলবেন ইহুদী নাসারা, কেউ বলবেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতি, কেউ বলবেন ইউরোপের ভোগবাদী সমাজ। সত্যি কি তাই? তাই মাঝে মাঝে ফেসবুকের পাতায় দেখা যায় নানা ধরনের গালি ছোঁড়া হচ্ছে উন্নত দেশগুলোকে লক্ষ্য করে। বেশ কিছুদিন আগে এক কৃষক বিপ্লবী নেতা ভাই তো বলেই বসলেন সমগ্র ইউরোপ শুয়োরের বাচ্চায় ভরে গেছে। সমগ্র ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলোর মানুষ যদি অমানুষ হয়ে থাকে তা হলে বাংলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কি ভাবে এত কমে গেল? আজ তো সেখানে বৈদেশিক শাসন নেই। পাকিস্তানী শোষণও নেই। শোষণের মাত্রা ভিন্ন হয়েছে বটে। তবে এর থেকে তো যে কেউ বের হয়ে আসতে পারে। যে বিশ্ব ব্যাংক চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছে তা যে কেউ ত্যাগ করতে পারে। সেই কলোনিয়াল যুগের মত হাতে বেড়ি দেবার পদ্ধতি আর নেই। তাহলে কেন আমরা নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে অন্যকে গালি দেওয়া শেখাচ্ছি?
এই কি আমাদের সাংস্কৃতিক পরম্পরা!!
উন্নত দেশ গুলো তাদের আভ্যন্তরীণ শোষণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। আভ্যন্তরীণ শোষণ যেখানে নেই সেখানেই মানবিকতার ভিন্ন মাত্রা বিকাশ ঘটছে। সেই মানবিকতার হাত ধরেই বিশ্ব মানবতার ডাক আসছে। আজ একে তথা কথিত দেশ প্রেমিকেরা এক নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে চালাচ্ছেন। তবে ষড়যন্ত্র যে নেই তা ঠিক না। এই ষড়যন্ত্রের দোহাই দিয়ে দেশীয় অপরাধীদের হাতে অত্যাচারের নানা ঘটনাকে ধামা চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব না। ইউরোপ তাদের দেশ গুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন একই মুদ্রানীতি সহ আরও অনেক নীতি গ্রহণ করে চলছে। কিসের কারণে তাদের এক হবার প্রচেষ্টা চলছে? গ্রীসের বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্ত দেশ এগিয়ে এসে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে।
একটি দেশের বিপর্যয় মানে ইউরোপের বিপর্যয়। আর ইউরোপের বিপর্যয় মানে পৃথিবীর বিপর্যয়। এই ভাবে আমারা আজও ভাবতে শিখি নাই। এর কারণ আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। সমাজে ন্যায় বিচার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানে মানবতার ভিন্ন রূপ। বিশ্ব মানবতার উপলব্ধি সেখানে কি ভাবে আসবে? এই কারণেই হয় তো আমাকে শুনতে হয় ” কানাডায় বসে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হচ্ছে?” আমি কানাডায় আছি বলেই আজ বিশ্বের সকল মানুষ নিয়ে ভাবতে শিখেছি। স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে শিখেছি। ঐ মাটিতে থেকে ক্ষুদ্র আবেগীয় দেশ প্রেম জাগতে পারে কিন্তু বিশ্ব মানবতার ডাক সেই কানে খুব কমই পৌঁছাবে।
এইভাবেই তৈরি হয়ে যায় আমাদের কপালের লিখন!!
এই যুক্তিহীন আবেগীয় দেশ প্রেম দিয়ে সমস্যা সমাধান না হয়ে বরং সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে। যেখানে সাগর রুনীরা নিজ দেশের মানুষ দ্বারাই নিজ গৃহে হত্যা হয় সেখানে কি ধরনের সভ্যতা বিরাজ করছে? তক্বীর হত্যার তদন্ত সরকারী উচ্চ পর্যায়ের থেকে বন্ধ করার আদেশ আসে সেখানে কি ভাবে মানুষ ন্যায় বিচারের আশা করতে পারে? ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সারা জীবন অতিবাহিত করার ফলে চিন্তায় ক্ষুদ্রতা থেকে যায়। কিন্তু এটি কোন দোষের কিছু না। বহির্বিশ্বের যোগাযোগের মাধ্যমে এই ক্ষুদ্রতা দুর করা সম্ভব। তবে কোন কিছু না জেনে অন্যের কারণেই নিজের ব্যর্থতার অজুহাত দেখিয়ে সমস্যা এড়িয়ে চলা যায় কিন্তু কোন দিনও সমাধান মিলবে না।
Nice post
LikeLike