লিখেছেন- চারু হক
কেবল ব্যস্তসমস্ত মহানগর পর্যায়ে নয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে, গ্রাম পর্যায়ে, এমনকি জ্ঞান উৎপাদনের দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পাঠাগার পরিস্থিতি দিনে দিনে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষকরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত প্রায় প্রতিষ্ঠান এখনও পাঠাগার ছাড়াই চলছে, এবং যেগুলোতে পাঠাগার আছে সেগুলো অধিকাংশ পাঠক ছাড়াই চলছে। এছাড়া, বাংলাদেশের বেসরকারি পাঠাগার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় জেনেছি দেশে বিদ্যমান প্রায় ২ হাজার পাঠাগারের মধ্যে হাতে গোনা দুচারটি বাদে বাকি সবগুলোই পাঠকের অভাবে ভুগছে; এবং পাঠক পাঠাগারের প্রাণ, তাই প্রাণের অভাবে আনুষঙ্গিক সবই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মডেল বেসরকারি পাঠাগার সুধীজন পাঠাগারে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে।
এই যখন পাঠাগার ও পাঠক সম্পর্কিত প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, তখন যদি পত্রিকা প্রকাশে শত শত পাঠক পাঠাগারে ঢুকতে চেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, পাঠাগারে একটি আসন পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাঠকেরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে- সেটা সত্যিই মুহুর্তমধ্যে চোখকে চকচকে করে দেবার দাবি রাখে। হ্যাঁ এমনটিই ঘটেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত একটি সংবাদে। কিন্তু যে-ই শিরোনাম পেরিয়ে সংবাদের ভেতরে ঢুকলাম, তখুনি সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
পড়ার জন্যে পড়া, আনন্দের জন্যে পড়া চাই
জেনে ধন্য হলাম- বিসিএস নামক একটি চাকরির পরীক্ষার জন্যই পাঠাগারের সামনে এত জনের এত অপেক্ষা, এতবড় দীর্ঘ লাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা; বিসিএস পাঠকদের কাছেই পাঠাগারের সব আসন দখল হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃত পাঠক সেখানে জায়গা পাচ্ছে না। এই হচ্ছে বিসিএস প্রার্থীদের অবস্থা।
বিসিএস অতিক্রমে প্রার্থীদের কী কী পড়তে হচ্ছে, এবং সেই পড়াগুলো তাদের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কী কাজে আসছে; অথবা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আর ননটেকনিক্যাল প্রার্থীদের কেন একই সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, কেন বছরে গড়ে ৩ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সৃষ্ট একজন কৃষিবিজ্ঞানী বা প্রকৌশলী তার অর্জিত জ্ঞানকে অস্বীকার করে তার শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিহীন প্রশাসন বা কাস্টমস ক্যাডারে সুযোগ পাচ্ছে, কেন একজন অর্থনীতিবিদ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-ভাষাবিজ্ঞানী- প্রযুক্তিবিজ্ঞানী-কৃষিবিজ্ঞানী-উদ্যোক্তা-ঐতিহাসিক হবার সম্ভাবনা রাখা একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ১ম বর্ষ থেকেই বিসিএস এর জন্য নানান রাষ্ট্রের রাজধানী, মুদ্রা, সাল তারিখ ইত্যাদি মুখস্ত করতে গিয়ে তার বাকিসব সম্ভাবনাগুলো চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হবে, এবং সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে- সেই অসুস্থ্য প্রবণতায় কেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি আর জাতির বিবেক দাবীদার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাও ইন্ধন যোগাবে ?
আমাদের একটা পাবলিক লাইব্রেরী আছে, কিন্তু সিরিয়াস পাঠক নেই
ভাল জিনিস কেন আমরা অনুসরণ করবো না? উন্নত বিশ্বে একটা লাইব্রেরীকে কেন্দ্র করে বহু সামাজিক কর্মকাণ্ড বছর ধরে চলে। সেখানে প্রতিটা পাঠাগারের সাথে একটা বড় সম্মেলন কক্ষ থাকবেই। সেখানে নানান ধরণের ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পাঠদান, টিঊটরিংসহ নানান সামাজিক কর্মযজজ্ঞের আয়োজন চলে। ইচ্ছে করলে আমারাও তা পারি। একটা উন্নত ও দক্ষ সমাজ মানে উন্নত দেশ, যার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠবে পরিবার থেকে। পাঠাগার এইসব দায়িত্ব নিজের কাঁধে অনায়াসে তুলে নিতে পারে।