ক্ষুধা জয়ের মহাকাব্য


aami

লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

 

সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। সালটা ছিল উনিশ’শ চুয়াত্তর। পুরা দেশটা তখন দুর্ভিক্ষের গরম কড়াইয়ের উপর। সেই কড়াইয়ের ভাপ অনেকের মতন আমাদের গায়েও লেগেছিল। কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে নিন্ম আয়ে আমরা তখন বেড়ে উঠছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে। অসুবিধের দিন পার হয়ে গেলে মানুষ সেগুলো আর অযথা ঘাটতে চায় না। সেদিনের সেই সংকট উতরানোর অভিজ্ঞতা আমাকে বারবার আজকের বাংলাদেশের এই সংকট পেরিয়ে আশার সূর্য্যের দিনে পৌছার সাহস যোগায়। সেই সব স্মৃতিচারন অপ্রয়োজনীয় নয় কিছুতেই, যদিও তাতে আবেগাপ্লুত হয় মন, দৃষ্টি আর্দ্র হয়ে যায়।

যাই হোক, এবার সেই সময়ের গল্পটাই বলি। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর। ঐ সময় আমদের একখন্ড আবাদী জমি ছিল খুলনা শহর থেকে বেশ দূরে। সেখান থেকে যে ধান আসতো তা দিয়ে আমাদের বছরের সাতটা মাস চলে যেত। বর্গাদার ঠেলাগাড়ি বোঝাই ধান নিয়ে আসছে শোলমারি থেকে খুলনা শহরে- আমাদের বাড়ীতে। ধান আর এলো না সেদিন, এলো দুঃসংবাদ। নির্জন রাস্তায় ধানে ভরা ঠেলাগাড়ি আক্রমন করেছে প্রায় শতখানেক ক্ষুধার্থ মানুষ। অল্প সময়ের ভিতরে ধানের বস্তাগুলো হাওয়া হয়ে গেল। খালি ঠেলাগাড়ি আর কাঁদকাঁদ চেহারা নিয়ে বর্গাদার আমাদের বাড়ীতে পৌছে বললো- পারলাম না কর্তা, পারলাম না শেষ রক্ষা করতে। হাড় হাবাতগুলো আমার সর্বস্ব নিয়ে পালালো। এইবার কর্তা আমারে মেরে ফেলেন- আমি আমানতে খেয়ানত করেছি।
বেচারা বর্গাচাষী আর কি করতে পারতো! তার আর দোষ কি?

famine (1)

ক্ষুধাকে তুলিতে ধরার ব্যার্থ চেষ্টা

সেই থেকে শুরু হলো আমাদের দুর্্যো গের দিন-রাত। বাবার ছোট একটা চাকরীতে আমাদের নয় জনের সংসার চলে। চালের দাম আস্তে আস্তে বিশ টাকায় পৌছাল, লবন চল্লিশে। রেশনে চাল গম দিত, সেসবও অপ্রতুল হয়ে উঠতে থাকে। সপ্তাহ পেরিয়ে সোমবার ভোর সকালে শত শত খরিদ্দার লাইন দেয় রেশন দোকানের দরজায়। যেন ক্ষুধার্থের স্তম্ভিত নিরব মিছিল। দশটা এগারোটার দিকে মালিক দোকান খুলে বলে- মাল পাওয়া যায়নি, গোডাউন খালি। আপনারা যার যার বাড়ী চলে যান। ক্ষুধার্থ মানুষগুলো বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে মাটিতে। প্রায়ই হয় এমনটা। তাহলে এখন বাঁচার উপায় কি হবে? 

আমার বড় ভাইটা একটু সৌখিন- কেমন যেন সব কিছুর থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আমরা বাকী দুই ভাই রাতদিন ভেবে মরি, কিভাবে বাপের আয়ের সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করা যায়। পুজি নেই, যা দিয়ে ব্যবসা করবো। শিক্ষা নেই, দক্ষতা নেই, যা খাটিয়ে চাকরী পাবো- কাজ করার জন্য বয়সটাও আমার তখন যথার্থ হয়ে উঠেনি। আমরা দুই ভাই ধান সেদ্ধ করে চাল বানিয়ে বেচি, কখনওবা গুড় বেচি বাজারে- হয়ে যাই খুচরা ছোট ব্যবসায়ী। আর পাশে থেকে সবকিছুর সমন্বয় করেন আমার মা। আমাদের সাহস দেন- ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে’ বলে বলে।

famine (2)

ইংরেজ উপনিবেশ সৃষ্ট বাংলার দুর্ভিক্ষ

আমার মা এক অদ্ভুত অর্ধশিক্ষিত মানুষ। আনোয়ারা আর মোকছেদুল মোমেনিন ছাড়া আর কিছু পড়তে তাকে দেখিনি কখনও। দুইবেলা খাওয়া এই ঘোর দুর্দিনে তিনি খেতেন সবার শেষে- অবশিষ্ট যা থাকতো তাই। প্রতি রাতে তার ভাগের থেকে একটা অংশ চলে যেত বাড়ীর পোষা কুকুর আর বিড়ালটার পেটে গোপনে। এদের কথা ভাববার কোন চেষ্টা আমরা করিনি কখনও, তিনি করতেন। মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যেতেন আমাদের কাছে। ধরা পড়ে কাঁচুমাচু করে বলতেন- আমার দুপুরের খাবার থেকে কিছু অংশ রেখেছিলাম পরে খাব বলে, কিন্তু ভুলে গেছি। গরমে পঁচে উঠেছে বলে ওদের দিলাম। মনে মনে বড্ড বিরক্ত হতাম- আমরা পাই না ভাত, আবার বিড়াল কুকুর। অসহায়ের মত বলতেন- ওরাও তো বাঁচবে। আগে না বুঝলেও এখন বুঝি- অনেক পড়াশুনা করে আমরা যতটা মানবিক হতে পারিনি, উনি পড়াশুনা না করেও তার থেকে অনেক বেশী মানবিক হয়ে উঠেছিলেন।

আমাদের পড়াশুনাও চলতে থাকে এর ভিতরে। নয়টা পেটের ক্ষুধা মেটাতে জীবনের আর সব বিষয় বন্ধ করে দিতে হয়। দিনে দুই বেলা খাওয়ার অভ্যেস করি। আগে যতটা খেতাম তার অর্ধেক খাওয়া শিখি। বড়লোক আত্মীয়-স্বজনের বাসায় হানা দেই- ধান-চাল কর্জ করি। মধ্যবিত্তীয় লাজ-শরম-দ্বিধা কাজ করে মনে, তারপরেও যাই। দিতে দিতে তারাও বিরক্ত হয়ে বলেন- তোরা তো শোধ দিতে পারিস না। কিভাবে কর্জ দেই? আমাদেরও তো বাঁচতে হবে। স্কুলে যাই আসি। আসা যাওয়ার পথে দেখি খোলা ডাস্টবিনে মানুষ আর কুকুরে ঝগড়া করছে হোটেল থেকে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্টের অধিকার নিয়ে। ছোট্ট মনে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। পেটে তখন আমারও ক্ষিদে। ভাবি- এসব খুবই স্বাভাবিক চিত্র। এইভাবে যেতে যেতে অনেকগুলো দিন মাস কেটে যায়।

১৯৭৫ এর আগষ্ট। প্রথম সপ্তাহ পার হয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়ে পাথর সময়। আমাদের দিন-রাত্রি যাপনের হাল হকিকত হয় আরো শোচনীয়, আরো উপবাসে ভরা। বাজারে আগুন। সেখান থেকে খাবার কেনার উপায় নেই। রেশনই ভরসা, কিন্তু সেখানেও সরবরাহ অনিয়মিত। ধনী আত্মীয়রাও যার যার জান বাঁচাতে ব্যস্ত। তাদের কাছে আমাদের অনেক ঋন খেলাপী। ঋন হয়েছে বিস্তর- ক্ষুধার কারণে। কি আর করা। আর বুঝি কোন পথ নেই। এবার আমাদের উপোসে প্রাণ দিতে হবে। বাঁচার পথটা আমার মা-ই আবিস্কার করলেন। বাড়ীতে আমাদের অনেকগুলো নারকেল গাছ। সবগুলো গাছের নারকেল খাওয়া সারা- একটা গাছ বাকী। তার মাথায় অনেকগুলো নারকেল ঝুলছে, আধাঝুনা। তারমানে, রয়েসয়ে খেলে দুই সপ্তাহ আমরা পার করে দিতে পারবো। সময় আমাদের এখন বড় শত্রু। তাকে কোন রকমে পার করা চাই। একজন গাছি দিয়ে নারকেলগুলো পাড়ালে তাকে একটা দিতে হবে- আমাদের বেঁচে থাকার রশদ কমবে একটুখানি। তাই গাছি না ডেকে আমার মেঝ ভাইটা অনভ্যাস্ত কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে গেল গাছে। সবগুলো নারকেল মাটিতে পড়লো।

আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ, ষোল তারিখ হবে। হা ষোল তারিখই বটে। আমি যথা নিয়মে বই খাতা কাঁধে ফেলে স্কুলে চলেছি সকালে। কিছুদূর এগুতেই তেমাথার মোড়ে মানুষের জটলা। সবাই জড় হয়ে রেডিওতে কি জানি শুনছে। আমি তাদের পাশ কাটিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাই। পিছন থেকে কে জানি ডাকছে- এই নুরু শোন, শোন। ফিরে এলাম তাদের জটলার কাছে। কাছে আসলে ওরা বললো- বাড়ী যা। স্কুলে যাবার দরকার নেই। সেখ সাহেবকে মেরে ফেলা হয়েছে সপরিবারে। বিরাট গোলমাল। আর্মি নামিয়েছে, যা বাড়ী যা। ওরা আমার বয়সে বড়, মুরুব্বী। মুরুব্বীদের কথা মাথায় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম। বিকেল বেলায় আমার মা দশটা টাকা হাতে দিয়ে বললেন- “যা বাজারে যা। আধা কেজি আতপ চাল নিয়ে আয়। লতিফার মা দুই ছটাক চিনি ধার দিয়েছিল, ঐ দিয়ে তোদের শিন্নী রান্না করে দেব রাতে। নারকেল শেষ”। নারকেল শেষ, তারপর কি? তারপর কি ক্ষুধার স্রোতে পানির দামে আবাদের জমিটা, বাড়ীর জমিটা ভেসে যাবে নাকি! বড়দের মুখের এসব কথা, আমরা যারা ছোট তাদের মাথায়ও ঢুকে পড়ে।

famine

আগামীকাল কী হবে!

খবর কানে আসে- অনেক গৃহস্থ্য পরিবার এই পাষাণ সময়ে রাস্তায় নেমেছে। তবে আমার মা আমাদের এসব ভাবনার আঁচড় থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সজাগ থাকতেন অষ্টপ্রহর। অসম্ভব জীবনিশক্তি ছিল আমার মায়ের- কখনও আশা হারাতেন না। আগামীকাল কী খাব জানি না- তারপরেও তার মুখে থাকতো হাসি। দশটাকা পকেটে নিয়ে বাজারে চলে গেলাম। আধা কেজি চাল কিনতে গিয়ে থলি ভরে নিয়ে এলাম আড়াই কেজি আতপ চাল। বেপারী বললো- ভাইডি, চাল ভরে গেছে বাজারে, রেশনে। আর কোন চিন্তা নেই। চার টাকা কেজি। যত পারো নিয়ে যাও। রাস্তায় জলপাই রঙের ট্রাক, মুহুর্মুহু কুঁচকাওয়াজের আওয়াজ কানে আসছে। আমাদের মাথায় চিন্তা নেই আর। পেট ভরে গেছে খাদ্য খাবারে। ক্ষুধা এখন অনেক দূরে। ভরপেট আমরা সারা রাত নিরাপদ নিদ্রা দিলাম।

সকালে উঠে সবার কাছে কেমন যেন পরিস্কার হয়ে গেল- আমাদের দুঃখের দিন শেষ। সবাইকে বুঝানো হলো, সবাই বুঝলো- এক মহাশত্রু, যে দেশের সবাইকে অনাহারে পিষে মারছিল, সে অপসৃত হয়েছে। আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের মতন কে যেন ক্ষুধার রাজ্যে খাবারের বন্যা বইয়ে দিল। কিভাবে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। রাজনীতির মারপ্যাচ মাথার পাশ দিয়ে চলে গেল। তারপরে বহু বছর পার হয়ে গেছে। অনেক বড় হয়েছি। বিদেশে এসেছি। প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, কিন্তু ভুলতে পারিনি সেই দিনের ক্ষুধা জয়ের কথা। আমার মায়ের জীবনি শক্তির কথা। কি উপায়ে তিনি প্রতিরোধ করেছিলেন সেই ভয়াবহ দিনগুলো তার ধৈর্য্য আর দক্ষতা দিয়ে – সেসব কথা। এখনও কে যেন সমানে আবৃত্তি করে চলে মনের গহীনে সেদিনের সেই ক্ষুধা জয়ের মহাকাব্যখানা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s