লিখেছেন- রওশনারা বেগম
সনটি ঠিক মনে নেই। তবে সম্ভবত ২০০০ সালের দিকের কথা। আমি তখন টরন্টোর নতুন বাসিন্দা। মাত্র ২/৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাসার পাশে একটি ফ্রেঞ্চাইজ রেস্তোরা টিম হর্টন ছিল। সেখানে পার্ট টাইমে দু-তিন দিন কাজ করতাম। সেই কাজের সূত্রে বেশ কিছু বাঙালী গৃহবধুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তাদের প্রত্যকের একটা পরিচয় ছিল, তা হলো তারা প্রত্যেকে কাজ করছেন, তবে তা সংসারের জন্য না। নিজেদের স্বাদ আহল্লাদ মেটানোর জন্য তাদের এই কাজ। সংসারের মত উৎকট ঝামেলা নেওয়ার দায়িত্ব তাদের না। এই দায়িত্ব তাদের স্বামীদের উপর। কাজের সূত্রে এই সকল গৃহবধূর সংগে পরিচিত হয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। এই সকল বধুদের পাশে আমি ছিলাম সব চেয়ে ছোট নতুন সংসারে প্রবেশকারী এক বোকা মেয়ে। তাদের সংগে মিশে আমিও বেশ পাকা সংসারী হয়ে যাই। তবে তাদের মত সাজগোজ-ওয়ালা গৃহবধূ আজও হতে পারি নাই। টিম হর্টনের কাজটি ছিল তাদের শখের কাজ। এই কাজে তারা যে টাকা অর্জন করতেন তার সবটাই ব্যয় করতেন নিজের সাজ সজ্জায়। তাই টিম হর্টন ছিল তাদের সাজ সজ্জার যোগানদাতা।
গৃহবধুদের কাছে কসমেটিক জগতের সমস্ত খবরাখবর পাওয়া যেত। স্বর্ণের দাম কখন বাড়লো কখন কমলো তার তথ্যগুলো ছিল তাদের জানা। স্কীন কি ভাবে ফর্সা করা যায়, কোন লোশনে গায়ের চামড়া চকচকে হয় এই সব নানা তথ্যে তারা ছিল মহাজ্ঞানী। তাদের মধ্যে শ্রেনী চেতনা ছিল বেশ তীব্র। স্বামীর চাকুরীর উপর নির্ভর করে জাতে ওঠার চেষ্টা চালাতে দেখতাম। স্বামীর পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করার মধ্যে একটা গর্ববোধও কাজ করত। নিজের অর্জিত টাকা দিয়ে নিজেকে কি ভাবে আরো পরনির্ভরশীল করা যায় সেই প্রতিযোগীতায় তারা মেতে থাকতো। শুনেছি কোন কোন ভাবী নাকি ঐ ফাষ্ট ফুডের দোকানে কাজ করে বস্তার পর বস্তা স্বর্ণের পাহাড় বানিয়েছে। এই ভাবে অনেক মেয়েমানুষের জীবনই সাজসজ্জা ও গয়নার মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। এর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা তাদের মধ্যে কখনো দেখি নাই। আবার অনেক স্বামীরাও মেয়েদের এই ভাবে পরজীবি হিসাবে দেখতে ভালবাসে।
নিজের বাহ্যিক রূপকে আকর্ষনীয় করে অন্যকে বিনোদন দেওয়াই যদি একমাত্র গন্তব্য হয় তা হলে মেয়েরা সারা জীবন বিনোদনকারী পন্য হিসাবে গন্য হবে। মানুষ হিসাবে তারা স্বাভাবিক মর্যাদা ফিরে আর পাবে না। অনেক উপায়ে বিনোদন দেওয়া যায়, তবে প্রবাসে এই বাংগালী গৃহবধুদের কোন শ্রেনীভুক্ত বিনোদনকারী বলবো তা আমার জানা নেই। বাহ্যিক পরিপাটি ও সৌন্দর্যের মধ্যে মনের প্রশান্তি রয়েছে তবে এর বাড়াবাড়িতে মনে এক ধরনের অসুস্থ্যতা দেখা দেয়। এই জন্য হয় তো বস্তার পর বস্তা স্বর্ণ সঞ্চয় করা লাগে। প্রতি মাসে পাচশত ডলার ব্যয় হয় ত্বকের যত্নে। যিনি রবীন্দ্র সংগীত প্রানে ধারন করতে পেরেছেন তাকে তো প্রতিটি গানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাড়ী পাল্টানোর প্রয়োজন হয় না। গানগুলোর সংগে একাত্বতাই তার বড় সৌন্দর্য। এখানেই তার স্বার্থকতা। এটি বুঝতে পেরেছিলেন সানজিদা খাতুন।
বাংলার ইতিহাসে যে কয়টি মহিলা পুরো বাঙালী জাতির মডেল হওয়ার যোগ্যতা রাখে তারা হলেন- বেগম রোকেয়া, নিলীমা ইব্রাহিম, বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, সানজিদা খাতুন। এই নারীগুলো হলো বাংলার জাগ্রতপুর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী। এরা যদি বাংলার নারী সমাজের মডেল হতে পারতো তা হলে সমাজে নারীর অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। কারন আমরা নারীরা এদেরকে মডেল হিসাবে প্রানে ধারন করতে পারি নাই। তাই প্রবাসে এসেও বাংলার নারীকে শুধুই বিনোদনকারী ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে ডুবে থাকতে দেখি। নারীর সামনে কিছু অনুকরনীয় মডেলকে দাড় করিয়ে ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যেই নারীর মুক্তি নিহিত রয়েছে।
ব্যক্তি নারী আর প্রাকৃতিক নারীর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নারীকে অনেক পরিশ্রম করেই ব্যক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারলে নারীর বিকাশ সাধিত হয়। আমার মনে নারীর মডেল হিসাবে যাদের নাম আমি উল্লেখ করেছি তারা সবাই এক এক জন ব্যক্তি নারী। তারা সবাই প্রাকৃতিক নারীকে অতিক্রম করে ব্যক্তি নারীতে রুপান্তর করেছেন। তাই তাদের চিন্তার সীমানা বৃদ্ধি পেয়ে মানব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।