লিখেছেন- নাদিরা সুলতানা নদী
এটা তো ঠিক, মানুষের তার নিজের হাত পা নাক চক্ষু বানানোর ক্ষমতা নাই…
নাই তার উচ্চতা বা অবয়বের উপরে কোন হাত।
এমনকি জেনেটিক বৈশিষ্টও অনেকে পায়না। অনেকেই আছেন মা বা বাবা কারো মতনই দেখতে না। বরংচ কথা নাই বার্তা নাই হয়ে গেছে বাবা বা মায়ের প্রথম বা প্রাক্তন কোন প্রেমিক/প্রেমিকার মতন, না মানে ঐ আরকি, যাকে বলে জাত ছাড়া!
আমার নিজের কথাই বলছিলাম। আমার পরিবারের প্রায় সবাই গড়পরতা উঁচা লাম্বাই, কিন্তু আমি নই! এমনকি সেই ১৯৫২ সাল (!) থেকে আমি যে ক্লাসে পড়ি, ময়মনসিংহের লুকজন (!) আমায় ধরে নিতো তার থেকে কম ক্লাস!!! …খুবই বেইজ্জতি এই বিষয়ের মধ্য দিয়েই ‘জীবনে ব্রত করলাম’ বড় যদি হবে, ছোট হও তবে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল গেটে প্রথম বর্ষেও বড় আপুদের কাছে আসা হ্যান্ডসাম ভাইয়ারা আমায় ভাবতো কোন না কোন আপুর কাছে বেড়াতে এসেছি। একদিন তো এক ভাইয়া ছোট আপু, তুমি কোথায় পড়? ইনিয়ে বিনিয়ে বলে কিনা ইয়ে মানে তুমি কার কাছে এসেছো,…… উনি পারলে আমায় চকলেট ধরিয়ে দেয় আরকি, ভিতরের কোন এক বড় আপুকে ডেকে দেয়ার জন্যে। আমি আর কি করবো, নীরবে সহ্যই করেছি, সয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই এই দুঃখে কোন প্রেমই হলোনা সময় মতোন!
নাড়ি-ছেড়া ধন আসে শিশু হয়ে, চিরশিশু হয়ে রয় সে মায়ের চোখে!
দিন একটু বদলালো, শাড়ী ধরলাম, কারনে অকারনে। শাড়ী পড়লেই আমার নিজের কাছেই একটু মনে হতো, আই এম আ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট। আমিই সেই নাদেরা নদী, যে কিনা মিছিলে মিছিলে শাড়ী পড়েই বহুদূর হেঁটেছি!
বিয়ের পর জবে ঢুকলাম, বছর না যেতেই ছোট এক অফিসের বড় এক দায়িত্ব। মিটিং টিটিং এ যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন, বাংলাদেশ অফিসে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্দান্ত স্মার্ট কিছু ছেলে মেয়ে আমার সাথে কাজ করতে আসে কয়দিন পর পর। তাঁদের কাছেও ‘সেন্টার ম্যানেজার’ হতে আর পারি কই। একেতো চেহারা থেকে হাসি নামানোই যায়না, তার উপর এমন জুনিয়র লুক, নাহ এর বিহীত না করলেই নয়। বিশেষ দিন মানেই খুব ভারিক্কী শাড়ী পড়ে হাজির হই মিটিংএ। চেহারায় একটা আলগা ভাব নেয়ার মিথ্যে চেষ্টায় টানটান থাকি, একটু রফা হয় আরকি, কোন মতে!
আমার মা জননী আমাকে এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্যে বিশাল এক উপদেশ দিলেন, চশমাটা নিয়ে নিতে। আমিও জননীর আদেশ শিরোধার্য ‘চোখের ডাক্তারের কাছে যেয়ে বললাম ইনিয়ে বিনিয়ে একটা চশমা দেবেন প্লিজ’। ডাক্তার আমাকে হতাশ করে দিয়ে বললেন, কেন চশমা পড়বেন, মানে কি কারণে? হলো না, এই বুদ্ধিও কাজে লাগানো গেলো না।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাস জীবন শুরু, কলিগদের সাথে পরিচয় পর্বের যে অংশে আমি বলি আমার একটা টিন ছেলে আছে, বেশীর ভাগ সময়ই একটাই কমন ডায়ালগ- ‘আর ইউ কিডিং’!!!
যে কারনে এই ঘটনার অবতারণা, আমার মা জননী আমাকে যেন একটু ভার দেখায়, সিনিয়র লাগে তার নানান রকম তরিকা দেয়ার চেষ্টা করেছেন একটা সময় পর্যন্ত। শেষবার বাংলাদেশে গেলাম, মনে করিয়ে দিলেন, পারলে একটা চশমা নিয়ে নিতে… সএবারও উনার আশায় গুড়েবালি!!!।
তবে ঘটনা এইখানেই শেষ হতে পারতো। হলোনা, ঘটনা প্যাঁচ খেয়েছে, মজাটা হচ্ছে, আম্মাজান যে কিনা আমার বয়েস বাড়ানোর চেষ্টা সত্তেও গত প্রায় ২ বছর ধরেই ফোনে কথা হলে আমাকে উপদেশ দেন, ‘মা’রে বয়েস হচ্ছে, একটু শরীরের দিকে তাকাও এবার, খাবার নিয়ে কোন অবহেলা করো না। ৪০ বছর হয়ে গেলে, এই হবে, সেই হবে। চল্লিশতম জন্মদিনটা আটকেই আছে, আটকেই আছে, আম্মার কাছে মনে হয়না আমি এটা পার করতে পারবো!!!
তবে দুঃখিত, এতো লম্বা করে ইনিয়ে বিনিয়ে খুব এলেবেলে কিছু অনুভূতির একান্ত শব্দমালা পড়ানোর জন্যে… একটা সুখবর দেই, খুব মন ভালো নিয়ে লিখছি এই অনুভব। এবার বেঁচে থাকলে নেক্সট জন্মদিনটা, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, পালন করতে পারবো আম্মাকে নিয়েই। কেউ আবার জিজ্ঞেস করবেননা যেন, জন্মদিনটা কততম? সেটা আপনার বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম!!!
আমার মা জননী, দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশ থেকে আজ ৪ নভেম্বর ’১৭ রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে উড়াল দিচ্ছেন। উফ সামনের কিছু সময় আমি যে আরো কত ছোট হয়ে যাবো কে জানে, ভাবতে পাচ্ছিনা!!!
মায়ের কাছে পৃথিবীর কোন ছেলেমেয়েই বড় হয়না, আমৃত্যু ছোট্ট আদুরে বাচ্চাই থেকে যায়… এই যেমন আমি লিখছি আর একটা ছোট্ট বাচ্চা বাচ্চা ফিলিংস নিয়ে বুঁদ হয়ে আছি…!!!
না এবার শেষ করতেই হচ্ছে, আমিও যে ‘মা’ ভুলে গিয়েছিলাম কিছু সময়, ছেলের জন্যে খাবারটা তৈরি করিগে… ডাকাডাকি চলছে!!!
পৃথিবীর সব মায়ের জন্যে শুভকামনা, সরল সুন্দর আর ভালোবাসাময় হোক তাঁদের জীবন!!!
নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
৪ নভেম্বর ২০১৭
প্রত্যেকটা দিনই মায়ের। সেই হিসাবে সব দিনই মা দিবস। শুধু এক মা দিবসের স্মরণকে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার এই মহৎ ধারণাকে এপ্রিশিয়েট করি। লেখায় সুন্দর একটা অনুভূতি মূর্ত হয়ে উঠেছে।
LikeLike
A very good writing. Loved it.
LikeLike