লিখেছেন- এ টি এম গোলাম কিবরিয়া
আমাদের নতুন বইয়ের মলাটে যখন গোটা গোটা অক্ষরে নিজের নাম লিখে রাখাটা আর ফ্যাশনেবল মনে হচ্ছিলোনা, সেই সময়ে আমাদের সাথে সুবোধের পরিচয়। ক্লাস নাইনে শয়তান কাঁধের দুই ফেরেশতাকে সরিয়ে দিয়ে জাঁকিয়ে বসে, ক্রমশ দূর্বাদাড়ি অবিন্যাস্ত হওয়া শুরু করে, আমরা সাবালোক হওয়ার বাসনায় শয়তানের সাথে ফ্যান্টাসি বিষয়ক দরদাম শুরু করি। সে সময়ের প্রথম দেখায় সুবোধকে আমার হীনমন্য মনে হয়েছিলো। মানুষ মাপার যে বাটখারাটা আমি কাউকে দেখাইনা, তাতে সুবোধকে আমার নিরীহ লেগেছিলো, ফলত নতুন ছেলেদের যে ধরনের বুলিং করা পুরনোদের জন্য রেওয়াজ তার সবই আমরা করেছিলাম ওর সাথে। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত হিন্দুর অস্তিত্ব সংকট নিয়ে সর্বদা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ১৫ বছরের বালক হিসেবে সুবোধের যে রোল আমরা ঠিক করেছিলাম, সে মনযোগ দিয়ে তা চর্চা করছিলো। গোল বাঁধলো বার্ষিক পরীক্ষার দিন। হলের অজগরশীতল নির্জনতার মাঝে আমি যখন ফিসফিস করে ওকে অব্জেক্টিভ জিজ্ঞেস করছিলাম, ও মাথা ঘুরিয়ে আমাকে উত্তর দিলো,
“তুই আমাকে ডান্ডি বলিস ক্যান?”
আমার নিরুত্তর চোখের দিকে তাকিয়ে ও একটা হাসি ছুঁড়ে দিলো। তারপর একে একে উত্তর বলতে লাগলো।
শহরতলীর এই স্কুলে আমরা সকলেই স্ট্রীটস্মার্ট হওয়ার ভান করতাম। রাজধানীর দূরবর্তী ভালো স্কুলগুলোর কাজিনদের সুবাদে জানতে পারতাম কিভাবে কথা বললে ডেয়ারিং লাগে, কথার মাঝে কতটুকু গালি দেয়া কুলনেস, এইসব। এইধরনের হাসির উত্তরে কি বললে স্মার্ট শোনায় তা শিখে নিতে তখনো আমার ঢের বাকি। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে ওর জন্য নির্ধারিত করুনাটি আমি সরিয়ে ফেললাম। একজন অন্তরঙ্গ শত্রু হিসেবে ওর প্রতি আমার সম্ভ্রম জাগলো। সম্ভ্রম শব্দটির মাঝে একজন গাউন পরা মুখে পাইপ দেওয়া ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দেন, টিনেজারদের একজনের আরেকজনের প্রতি সম্ভ্রম জাগেনা, কিন্তু অন্য কোন সুইটেবল শব্দ নেই বলে আমি এটাকে সম্ভ্রমই ভাবছিলাম। এইরকম ভাবাভাবির খেলা দিয়েই ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা জমে উঠলো। ওর প্রিয় ভাবনা ছিলো বাবা মারা গেলে ও কিভাবে কাঁদবে কিংবা ওর মা যদি আরেকজনের সাথে পালিয়ে যায় তাতে ও কয়দিন মন খারাপের কথা বলে স্কুলে আসবেনা এইসব। আমি ওকে বলতাম আত্মহত্যার কথা, সম্পন্ন ফ্যামিলিতে দুঃখজনকভাবে জন্ম নেয়ার কারনে আমি যে জীবনে কোন স্ট্রাগল করতে পারবোনা আমার এই কস্টে ওকে সিন্সিয়ারলি কাতর দেখাতো। আমরা সচেতনভাবে সিনেমা, বই ও জীবনের বাউন্ডারি মিশিয়ে দিচ্ছিলাম এক নদীতে। সাঁতার না জানাটাই আমাদের মুন্সীয়ানা ছিলো।
জীবন গল্পকে ফলো করে। ফলে গল্পের প্রয়োজনে ওর সাথে আমার একটা বহনযোগ্য বিচ্ছেদ জরুরী হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়, আমরা একজন আরেকজনকে মক করি, তারপর কম যোগাযোগ হয়, তারপর আর হয়না। পুরনো বন্ধুদের কাছে আমরা আমাদের একটা জিহবা আর একটা কান জমা দিয়ে রাখি। যখন দরকার বলি, যখন প্রয়োজন শুনি। একধরনের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনের মত তারা থাকে। আমাদের সাথে।
“দোস্ত, তুই কি একটু পার্থ যাবি”?
প্রাইভেট নাম্বার দেখেই ফোনটা ধরেছিলাম। পরিচিত কারো মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার আশঙ্কা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রবাসীরা রাতের ওভারসিজ কল একধরনের থ্রিল নিয়ে ধরেন। ব্যাপার কিছুই না। সুবোধের এক্স গার্লফ্রেন্ড পার্থ থাকে, তার একটি সন্তান হয়েছে, আমি যেন গিয়ে দেখে আসি। কেন দেখবো, কি দেখবো, কিছুই বুঝলামনা। মেয়েটিকে আমি দেখেছি সুবোধের সাথে আগে। পরিচয়ের দিন সুবোধ খুব জড়োসড়ো ছিলো, প্রেম শব্দটি নিয়ে আমার আপত্তির কথা ও জানতো। আমরা টিনেজে নিশ্চিত ছিলাম প্রেমের মতন প্রথাবদ্ধ কোন ব্যাপারে আমরা জড়াবোনা। ওইদিনের কথা ভাবলে তাই একজন মাছুম বিশ্বাসঘাতক ও একটা আনকোরা মেয়ের কথা মনে পড়ে আমার।
“আমি তো পারবোনা দোস্ত, পার্থ এইখান থেকে অনেক দূরে। আর গিয়া লাভ কি?”
আমার উত্তরে সুবোধ কিছুক্ষন নীরবতা ঝুলিয়ে রেখে বলে,
“আমার মাংস আর ওর আত্মা, আমার মাংস আর ওর আত্মা”
তারপরে কেটে দেয় কল।
এই ঘটনার পরে ওর সাথে আমার আবার মাঝে মাঝে কথা হওয়া শুরু হয়। আমাদের টিনেজের ভাবনাগুলো নিয়ে আমরা পরস্পরকে খোঁচাই মাঝে মাঝে, ও একদমই অপ্রস্তুত হয়না। সময় ওকে বিব্রত করতে পারেনা একেবারে। স্পোর্টস, রাজনীতি, দেশ সবকিছু নিয়ে আলাপ করি। একজন প্রবাসী হিসেবে “এই দেশের কিচ্ছু হবেনা” বলার যে দায় আছে আমার আমি তা বলি, ও সস্নেহে আমার কথাকে পাত্তা দেয়না। একদিন আচমকা আমাকে বলে, জানিস পেইন্টারদের কিন্তু জিহবা কেটে ফেলা লাগে, নাহলে তারা বেশী বলে ফেলে।কথাটা কার জিজ্ঞেস করতেই বলে, এটা মাতিসের কথা কিন্তু আমার খুব পছন্দ। ততদিনে ঢাকার দেয়াললিখন গুলো মোটামুটি কাভারেজ পাওয়া শুরু করেছে মিডিয়ায়। আমি ওকে আর জিজ্ঞেস করিনা কেন ও এইসব লেখে? একদিন শুধু কথায় কথায় বলি, ব্যাঙ্কসি অনেক সফেস্টিকেইটেড। রিচ অনেক বেশী।ও হাসে। বলে, হ্যাঁ দোস্ত, আমরা অনেক ক্ষ্যাত। হিহিহি।
আজকে ওর গ্রেফতার হওয়ার ভুয়া খবর শুনেই ফোন দেই ওকে।
“কিরে, তুই নাকি জেলখানায়?”
“আমি তো মুক্ত দোস্ত, কিন্তু জেলখানায় এত লোক এরা জানেইনা যে এরা কয়েদ, হিহিহি”
সুবোধের জিহবাটি তড়পাতে শুরু করে।