এক হারিয়ে যাওয়া ডাক্তার


D$

লিখেছেন- রওশনারা বেগম

 

নীরবে চলে যাওয়া এক ডাক্তারকে প্রায় স্মরণ করি। নাম তার কার্তিক বাবু। তিনি প্রতিষ্ঠানিক লেখা পড়া জানা ডাক্তার ছিলেন না। তিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদির হয়ে লেখা পড়া করে একজন জনদরদী মানব সেবক ডাক্তারে পরিনত হয়েছিলেন। খুলনার পুরাতন মানুষগুলোর অনেকেই হয় তো এই ডাক্তারের নাম শুনেছেন। খুব ছোট বেলায় আমার সুযোগ হয়েছিল তাকে কাছ থেকে দেখার। তিনি আমাদের প্রতিবেশীও ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি বৃটিশ আর্মিতে চাকুরীরত এম বি (Bachelor of Medicine) সুধীর দাসের কাছে থেকে মেডিসিন বিষয়ে লেখা পড়ার সুযোগ পান। সুধীর বাবু ছিলেন সেই সময়ের নামকরা ডাক্তার। তার কাছ থেকে সমস্ত ডাক্তারী বিদ্যা রপ্ত করে সারা জীবন এই কার্তিক বাবু মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

D1

তার পরের ঘটনা গুলো আরো করুণ। দেশ স্বাধীন হলেও তিনি আর ওপারে, মানে কলিকাতায় না যেয়ে নিজের পৈত্রিক বসতভিটায় খুলনায় থেকে যান। আমি তাকে দেখেছি তার বৃদ্ধ বয়সে, স্বাধীনতার অনেক পরে। অসুখ বিসুখে তিনি রুগীর বাসায় বাসায় গিয়ে সেবা দিতেন একপ্রকার বিনা মুল্যেই। তার বড় মেয়েটি ছিল আমার বড় বোনের বান্ধবী। সেই হিসাবে তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক একটা যোগাযোগ ছিল। আমার ঐ বার-তের বছর বয়সে প্রায়ই শুনতাম তিনি কলিকাতায় চলে যাবেন। কিন্তু তার আর যাওয়া হলো না। যখনি তিনি যাবার প্রস্তুতি নিতেন তখনি তার বাসায় ডাকাতি হতো। এইভাবে তিন-তিন বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। বড় হয়ে জানতে পেরেছি ডাক্তার বাবুর যে মেয়েটি আমার বোনের বান্ধবী ছিল সে স্থানীয় এক রাজাকার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে পরে আত্মহত্যা করে। সেই রাজাকারকেও কার্তিক বাবু সেবা দিয়েছিলেন। তারপরেও তার মেয়েটি রক্ষা পাননি। যে গ্রামে তিনি থাকতেন সেই গ্রামের এমন কেহ নেই যে তার চিকিতসা সেবা পায়নি। অথচ সেই গ্রামের মুসলমান দ্বারাই সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তার সমস্থ জ্ঞাতি গুষ্ঠি সবাই কলিকাতায় চলে গেলেও তিনি আর যেতে পারেননি। সেই সময়ে ঐ অল্প বয়সে ঠিকমত বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি- কেন গভীর রাতে আমাদের বাসায় বৃদ্ধ দিদিমার যাতায়ত চলতো, কেন তাদের মধ্যে এত আতঙ্ক ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরেও।

স্বাধীনতার পর নব্য রাজাকার দ্বারা তার পরিবারের শেষ সম্মানটুকু ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে চলে সম্পদ লুটের তান্ডব। এই ভাবে তিনি স্বাধীন বাংলার নব্য রাজাকার দ্বারা নিঃশেষ হয়ে গেলেন। অবশেষে সম্ভবত ৮৫/৮৬ সালে মারা যান কার্তীক বাবু। আমি তখন খুলনা মন্নুজান স্কুলের সেভেন কিংবা এইটের ছাত্রী। ক্লাসে এক শিক্ষক আমাদের জানালেন- তোমরা হয়তো কার্তিক বাবুর নাম শুনেছো। তিনি মারা গেছেন, এটি আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তোমাদের মধ্যে যারা এই ডাক্তারি পেশাটি গ্রহন করবে তারা কার্তিক বাবুর মত মানুষের সেবাটুকু দেবার চেষ্টা করবে। এই ছিল সেই দিনের উপদেশ। আজ এতটা বছর পরে এসে এই টরোন্ট শহরে বসে তাকে স্মরণ করি। সারা জীবন তিনি সেবা দিয়ে গেছেন, বিনিময়ে যা পেয়েছিলেন তা স্মরণে আসলে চোখের জল ছাড়া কিছুই পাই না।

D2

 আমরা কি এজন্যই স্বাধীন হয়েছিলাম? শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে কার্তিক বাবুর মত এক মহান ডাক্তার কে কুরেকূরে মরতে হয়?  নব্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে তার পৈতৃক শিকড়কে উপড়িয়ে ফেলতে বুক কাঁপে না কেন মানুষের? তার চোখেতো হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। তারপরেও তিনি এর শিকার হন। আজ যখন সেই পুরাতন  মাটিতে যাই তখন সেই মহান ডাক্তার বাবুর কোন চিহ্ন দেখতে পাই না। চারিদিকে তাকাই যদি তার নামে কোন স্কুল কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে এই আশায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। সেই কার্তিক বাবু তো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ার মত মানব ছিলেন না। তাহলে  কেন আজ তার কোন চিহ্ন সেই মাটিতে নেই? এর উত্তর আমার জানা নেই। যদি কোন দিন আমার সুযোগ আসে তাহলে তার মুছে যাওয়া নামটি সামনে এনে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই- ডাক্তার হলে কার্তিক বাবুর মতন হওয়া চাই।

1 Comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s