লিখেছেন- মনজুরুল হক
এক সময় মাথার চুল ছিড়ে আক্ষেপ করে এই শহরের ফ্লাইওভারগুলো ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই কথাটা শুনতে যতটা অভূতপূর্ব মনে হোক না কেন, কার্যত সেটাই ঘটবে। সেটা দশ বছর পর না কুড়ি বছর পর সেটাই বিবেচ্য। এরই মধ্যে আরও একটি ফ্লাইওভার চালু হল এবং আরও একবার সেটি মানুষের কোনো কাজে আসল না বলে প্রমাণ হল!
মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার করতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে কাজ শুরু করে শেষ হল ২০১৭ সালের নভেম্বরে। এর মধ্যে চার বার ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এবং তা পাশ করিয়েও নেয়া হয়েছে। ছয় বার কাজ শেষ করার ‘শেষ সময়’ ঘোষণা হয়েছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এরমধ্যে সরকার অর্থায়ন করেছে ৪৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) দিয়েছে ৭৭৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
চার লেনের এ ফ্লাইওভারে ১৫ স্থানে উঠানামার ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো হলো তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং শান্তিনগর মোড়। এটি রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি পিলার পাইলের গভীরতা প্রায় ৪০ মিটার।
এ ধরণের দুর্গতি সারা বছরই সহ্য করতে হয়েছে
ফ্লাইওভারটির নির্মাণের জন্য গত চার বছর ধরে কাকরাইল, রাজারবাগ, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, ইসকাটন রোড, রমনা, তেজগাঁও, বাংলামটর, চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, খিলগাঁও, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী এবং আউটার সার্কুলার রোডের বিস্তির্ণ এলাকার মানুষ অবর্নণীয় কষ্ট ভোগ করেছে। এই সময়ে নোংরা কাদা-জলে, আছড়ে পড়ে আহত হয়েছে শত শত মানুষ। শত শত বাসা বা ফ্ল্যাট থেকে মানুষ চলে গেছে অন্য এলাকায়। হাজার হাজার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। লাল লাখ মানুষের শত শত শ্রম ঘন্টা নষ্ট হয়েছে। লক্ষ মানুষের স্নায়বিক সমস্যা হয়েছে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার শিশুর স্কুল যাতায়াত ভীতিকর হয়েছে। তার পরও মানুষ সব মুখ বুজে সহ্য করে শাসক শ্রেণি কথিত- ‘বৃহত্তর কল্যাণের’ জন্য! কি সেই কল্যাণ? না, এই এলাকা তো বটেই, সারা ঢাকা শহরের যাতায়াতে বিরাট সুবিধে হবে! মানুষ সুবিধের চোটে হাত-পা ছুঁড়ে আনন্দ প্রকাশ করবে!
ওভারপাসটি (এটাকে ফ্লাইওভার বলা যাবে না, কারণ পৃথিবীর কোথাও ফ্লাইওভারে ট্রাফিক পুলিশকে ডিউটি করতে হয় না। এখানে তাই করতে হচ্চ্ছে!) চালু হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে কোনো প্রান্ত থেকেই যানবাহন তেমন একটা উঠছে না! ভোর সন্ধ্যেবেলা যাকে বলা হয় পিক আওয়ার, সেই পিক আওয়ারেও ওভারপাসের ওপর গাড়ি নেই! মগবাজার প্রান্ত থেকে সামান্য কয়েকটি প্রাইভেটকার উঠছে, কিন্তু রাজারবাগ, শান্তিনগর এবং চৌধুরীপাড়া প্রান্ত থেকে কালে ভদ্রে দুএকটা প্রাইভেটকার এবং মটর বাইক উঠছে। তা বাদে পুরো ওভারপাসটি ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেন উঠছে না?
এভাবেই সারা বছরজুড়েই যেন বর্ষাকাল ছিল!
এটাই অনুমেয় ছিল। যানবাহন এতে উঠবে না। এই হিসেবটা কোনো বিশেষজ্ঞ করেননি। বিদেশ থেকে ডিগ্রিফিগ্রি নিয়ে আসা নগরবিদ, পরিবহন বিশেষজ্ঞ, যানবাহন এক্সপার্ট এবং সরকারের টাকা হালাল করা সচিবগণের কারো মাথায় আসেনি এই রুটগুলোতে কোন ধরণের যানবাহন চলাচল করে? সেই সব যানবাহন ফ্লাইওভারে কেন উঠবে, এবং কেন উঠবে না?
আমরা জানি সদরঘাট/গুলিস্তান/সায়দাবাদ-যাত্রাবাড়ি থেকে উত্তরাঞ্চলে ডজন ডজন রুটের যানবাহন চলাচল করে। এই বাসগুলোর অন্যতম যাত্রী ওঠানামার স্টপেজ হল মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ এবং শান্তিনগর। এইসব স্টপেজে বাসগুলো না দাঁড়িয়ে ফ্লাইওভারে উঠবে কেন? তাহলে যাত্রী তুলবে কিভাবে? নামাবেই বা কিভাবে? এই রোডে ট্রাক তেমন একটা চলে না। সবচেয়ে বেশী চলে বাস, মিনিবাস। সেই সব বাস-মিনিবাসের একটিও ফ্লাইওভারে উঠবে না। শুধুমাত্র যে সকল বাস সিটিং হিসেবে পরিপূর্ণ হয়ে আসছে তারাই ভিড় এড়াতে উঠবে। তাও হাতে গোণা দুচারটে। আর উঠবে প্রাইভেটকার। মূলত ঢাকায় ফ্লাইওভার বানানোই হচ্ছে ওই প্রাইভেটকারের সাবলীল যাতায়াতের জন্য। যেহেতু রাতারাতি কোনো যাদুমন্ত্রবলে রিকসাকে তুলে দেয়া যাচ্ছে না, তাই ফ্লাইওভার বানিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে চান তারা। কিন্তু একটা সময় তো সেই প্রাইভেটগুলোকে নীচের গার্বেজ সড়কে নামতেই হবে, তখন?
পর পর দুদিন সকল প্রান্ত দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠে পরীক্ষা করে দেখেছি। বেশ ভালো লাগে! কেমন ফাঁকা ফাঁকা, খালি খালি, হালকা হালকা, ভিড়ভাট্টা নেই, শুনসান…. ভালোই। আর তখনই খচ করে ওঠে! গরিব দেশের ততধিক গরিব জনগণের রক্তঘামে দেয়া ট্যাক্সের টাকার কী নিদারুণ অপচয়! এদের হাবভাব দেখলে মনে হবে এইসব অপচয় আদতে কোনো অপচয়ই নয়, বরং মহা উন্নয়নের মহড়া মাত্র। মহা উন্নয়নের নতুন সোপানের এক্সপেরিমেন্ট! আপনি যখন এই ফ্লাইওভারটির নীচে রাত-দিন নরক গুলজার দশা দেখবেন তখন কি একবারও মনে হবে না, তাহলে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই শ্বেতহস্তি বানাতে হল কেন? কেন এখনও ফ্লাইওভারের নীচে হাজার হাজার যানবাহন গগনবিদারি হর্ন বাজিয়ে পুরো এলাকায় যানজট ঘটিয়ে লাখ লাখ মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে?
এই পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে দাগকাটা আফসোস হল এতসব জালিয়াতি, ধাপ্পাবাজী, ফেরেপবাজী, চুরি-চামারি, তসরুপ-অপচয়, বেদরকারী-অদরকারী, ফুটানি-বাহাদুরি আর ট্যাক্সের টাকায় উন্নয়ন মচ্ছবের ফলসিফাইতে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। হয়নি কখনো। হবেও না কোনোদিন। আমরা একে সামান্য ‘উন্নয়নের প্রসব বেদনা’ হিসেবেই বুঝতে শিখেছি। আমাদেরকে ব্যাটন, পিপাস্প্রে, বুলেট, জেল-হাজত-গারদে পুরে সেভাবেই বোঝানো হয়েছে। আমরা বুঝতে বাধ্য!