ভালবাসার তত্ত্ব


দেহ সর্বস্ব ভালবাসায় কোন ভালবাসার সৃষ্টি নেই। এটিকে ঠিক ভালবাসা বলা যায় না। এটিকে যন্ত্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যার মধ্যে সুক্ষ কোন আবেগ অনুভূতির চিহ্ন থাকে না। এটি শুধু জৈবিক তাড়নার উপর নির্ভর করে দুটি মানব মানবীকে কাছে নেয়। তাই এটি অন্যান্য প্রাণীর মত শুধু যৌন সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু শারীরিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে যে সম্পর্কগুলো তৈরি হয় তাতে ভালবাসার বন্ধন থাকে না। তাই দুদিন পরেই শুরু হয় এক ঘেয়েমি। অনেক সময় লোক চক্ষুর ভয়ে বিচ্ছিন্ন না হয়ে কোন রকমে পার করে নিয়ে যায় নিরানন্দ জীবনের ভার। এটি কোন জীবন না। উন্নত দেশগুলো এই পথটি সহজ করে দিয়েছে। যৌনতা আর ভালবাসা এক সাথে না থাকলে মানব জীবনের রূপ, রস, গন্ধ, শিল্প, সাহিত্য কোনটি উপভোগ করা আর সম্ভব হয় না। এখানে সেপারেশনে সাময়িক সমস্যা সমাধান হয় বটে কিন্তু স্থায়ী ভাবে সমস্যাটি থেকে যায়। তা হলো বহুগামিতা। মানুষ মাত্রই বহুগামী। তাকে কষ্ট করেই একগামী হওয়া লেগে। এটি উন্নত মানুষ হবার একটা চেষ্টা। বিশ্বজনীন জ্ঞান আর বোধ যদি কোন ভালবাসায় উপস্থিতি না থাকে সেখানেই নানা ধরনের মনের সংকীর্ণতা ও জড়তা ভর করে সকল সুন্দর সম্পর্কের পতন ঘটিয়ে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে যা অনেক মানুষের জীবনের ব্যর্থতা। যে পুরুষ বা নারী সারা জীবন লিঙ্গ ভিত্তিক বিভক্ত সমাজে বড় হয়েছে সেই নারী বা পুরুষ কখনো লিঙ্গ উত্তীর্ণ ভাবনায় যেতে পারে না। আর এই লিঙ্গ উত্তীর্ণ ভাবনায় রয়েছে মানবিকতায় উত্তরণের একটা সিঁড়ি।

যে মানুষটির কোন দর্শন নেই তাকে পড়তে হয় অন্য কোন মাধ্যম দিয়ে। আর এই মাধ্যমেই সেই অদেখা মানুষের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা খুব সহজেই তৈরি হয়ে যায়। এই কারণে হয় তো অদেখা আল্লাহর প্রতি, অদেখা নবীর প্রতি মানুষের এত ভালবাসা জন্ম হয়েছে যে চারিদিকে তাদের নিয়ে সকল কর্মকাণ্ড দেখা যাচ্ছে, মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। এটি ইহোজাগতিক কোন ভালবাসা নয়। এর মধ্যে কোন যুক্তি নেই, যা আছে তা হলো শুধু আবেগ সর্বস্ব জ্ঞান। এটিকে অন্ধ ভালবাসা বলা যায়। এই অন্ধ ভালবাসায় সৃষ্টি ধ্বংস হয় যা মানবতার ইহোজাগতিক ভাবনার বিরুদ্ধচারী। আর এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মানুষের মধ্যে সত্যিকারের ভালবাসা জাগ্রত করতে হবে। এই পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। শুধু চোখটা ঠিক মত মেলতে পারা না পারার উপর নির্ভর করে এই দেখা। ঘটনাক্রমে ভুল জায়গায় চোখ মেলে ভুল জিনিস দেখে আঁতকে উঠি, ভুল মানুষের হাত ধরে ভুলের যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে অপচয় করে ফেলি মূল্যবান সময় গুলো। চারিদিকে এই সব মানুষের সংখ্যাই বেশী। দিনে দিনে এর সংখ্যা বেড়েই চলছে। জীবন একটাই। দ্বিতীয় বার এটি ফিরে পাওয়া যায় না, তা কখনো ফিরে আসে না, আসবে না। তাই পুরানো ঘটনার কোনই সুরাহা হয় না। যা হয় তা হলো কিছু কষ্ট জমা হয়, কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। তাই আমি অভিজ্ঞতাটুকু আমার সঞ্চয়ে রেখে বাকী সবটুকু খুব দূরে ছুঁড়ে ফেলে সামনেই এগিয়ে যাব। এটাই আমাদের সামনে চলার দর্শন। কাউকে পরিবর্তনের ইচ্ছা করা অন্যায়। তা করা যায় না। নিজেই পরিবর্তন হয়ে যেতে হয়। নিজের চলার পথ একান্ত নিজস্ব। কেউ হয় তো সেই পথের সাথী হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যাকে আঁকড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছি সেও এক সময় দূরে চলে যাবে। তাই এখানে আমরা সবাই একা। সঙ্গে নিয়ে চলার সৌভাগ্য সবাইর হয় না। তাই বলে জীবনের সব কিছু ব্যর্থ হয়ে যাবে? তা কখনোই নয়। প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময় ভাবনার সমীকরণে গড়া। এটাই জীবনের বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যময় জীবনকে ভালবেসেই সামনে চলার উৎসাহ পাই।

ভালবাসা কি জিনিস? এটি কি শুধু আবেগ ও যৌনতা মিশ্রিত কোন মিথোজীবিতা? আসলে এক কথায় একে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এটি শুধু মানব মানবীর সম্পর্কের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। এই সম্পর্কের বাইরেও এর অস্তিত্ব সর্বত্রই দেখা যায়। ভালবাসায় আপ্লুত কবি তার কাব্যের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল উপকরণ এনে পাঠককে উপহার দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে অনেক জায়গায় এক অসীম ভালবাসার মাধুর্য দেখা যায়। অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘ সখি ভালবাসা কারে কয়’’ এখানে ভালবাসার সুন্দর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় পাই যা প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতাকে স্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের জিনের মধ্যেই রয়েছে স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা ও ভালবাসা একত্রিত হয়ে একটা সম্পর্কের ভাঙ্গন হয়। তবে ভালবাসা নিজেই একটা স্বার্থপরতা তবে এই স্বার্থপরতা অন্যকে তেমন আঘাত করে না। নিজের মানসিক প্লেজারটি ঠিক রাখার চেষ্টা করে। অন্যের প্লেজারও এর সাথে জড়িত। তবে যেখানে শুধু একজনের প্লেজার থাকে অন্যজনের থাকে না সেখানে কি ভালবাসা ব্যর্থ? আমার কাছে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। স্বার্থ আর ইগো যেখানে বড় হয়ে মাথা চড়া দেয় সেখানে প্রকৃত ভালবাসার অস্তিত্ব থাকে না। যা থাকে তাহলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের টানাপড়েন। প্রকৃত ভালবাসায় কোন অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় না বরং অধিকার বিহীন একটা নিরাকার বর্ণনাহীন আবেশে আপ্লুত হয়ে একটা মানবীয় সম্পর্কের সূচনা তৈরি করে। খুব কাছাকাছি এলে এই ধরনের সম্পর্কের টানা পড়েন তৈরি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শরীর ও মনের মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় এটি প্রকাশিত হয়। আমি অনেক কেই বলতে শুনেছি ‘ আমার ভালবাসার পাত্রটিকে দেখতে এমন হতে হবে যে প্রথম দর্শনে সবাই যেন মুগ্ধ থাকে, টাকা পয়সা দিয়ে আমাকে খুশী রাখবে ইত্যাদি অনেক শর্ত থাকে। তেমনি ছেলেরাও এমন ভালবাসার পাত্রী খোঁজে যে চেহারায় সুন্দরী হয়ে বাহ্যিক আকর্ষণে যৌনতাকে সব সময় উজ্জীবিত রাখে। এইগুলো সবই ত্রিমাত্রিক।

প্রকৃত ভালবাসায় শর্ত থাকতে পারে না। অর্থাৎ ভালবাসা হলো বন্ধনহীন মুক্ত ভাবনা সেখানে যৌনতা মুখ্য না। সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের লেনদেন থাকে না। যা থাকে তাহলো অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মায়া মমতার বন্ধন। ভাল মন্দ মিশিয়ে মানুষ। যে প্রকৃত ভালবাসা দিতে জানে সেই ভালবাসা মানুষের মধ্যে নিত্য নতুন ভালা ভাল জিনিসগুলো বের করে এনে এক গভীর ভালবাসায় আপ্লুত হয়। যদি কোন নেতিবাচক কিছু থেকেই থাকে তখন তা অতি গোপনে সরিয়ে রাখে। কাক পক্ষীকেও জানতে দেয় না। ভালবাসা দিয়েই সে জয় করে নেয় অনেক কিছু। আমি যে মানুষটি ভালবাসি সে কি ১০০% খাটি? এটি অসম্ভব। মানুষকে কষ্ট করেই মানুষ হবার চেষ্টা করে যেতে হয়। আর সেই চেষ্টাই ভালবাসার মানুষটির সহযোগিতার হাত চায়। আর এই কাজে ভালবাসা আল্পুত মানুষটি সহযোগিতার হাতটি বাড়িয়ে দেয়। যাকে আমরা ভালবাসি অন্তর দিয়ে তার ছোট ছোট ছিদ্র গুলো খুঁজে তা জন প্রকাশ্যে প্রকাশিত করে অপমান করা কি সম্ভব? সেই ক্ষেত্রে এই সুন্দর সম্পর্ক আর থাকে না। যা থাকে তাহলো একে অপরের প্রতি হিংসা আর বিদ্বেষ। ভালবাসায় লিপ্ত যুগলের মধ্যে কোন প্রতিহিংসা, প্রতিযোগীটা থাকে না। আর এখানেই একটি সুন্দর মানবীয় সম্পর্কের সূচনা হয়। এ রকম একটি ভালবাসার সুন্দর প্রকাশ পাই রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা”

শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি।
যে পারিবে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি, 
এবার পূজায় তারে
আপনারে দিতে চাই বলি।

1 Comment

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s