চক্ষুলজ্জা


লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

 

লজ্জা দুই রকমের। এক হলো- গুপ্ত অঙ্গ ঢাকা না-ঢাকা বিষয়ক লজ্জা, আরেক হলো লোকলজ্জা বা চক্ষুলজ্জা। গুপ্ত অঙ্গ ঢাকার অভ্যাস মানুষ পেয়েছে সুদীর্ঘ বিবর্তনীয় পথ ধরে। একজন বিবর্তনবিদ এই বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন। তবে অভ্যাসটা ভালই, কারণ এর ফলে মানুষের যৌন জীবনে একটা শৃঙ্খলা এসেছে। মানুষ এর ফলে নিজেকে অন্ততঃ সভ্য বলতে পারার মতন যোগ্যতা অর্জন করেছে। লজ্জা নিবারণের এই অভ্যাস মানুষের সমাজে বেশ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এটা কারও পক্ষে আর উল্টানো সম্ভব নয়। বলা যায় এর পরে সেই বিবর্তনীয় ধারায়ই মানুষের উপর এসে অতঃপর ভর করেছে লোকলজ্জা বা চক্ষুলজ্জা। এটা একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর সুপার-ইগো বা বিবেক, যা গড়ে উঠে লোকে কি বলবে, লোকে কি ভাববে ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। তা হোক, এই জিনিস থাকার ফলে সমাজে বসে মানুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না। লোকে কি বলবে এই ভেবে সে নিজেকে সংযত করে।

তবে লোক লজ্জারও বহুরূপ আছে, যা দেখে সেটাকে অনেকের চক্ষুলজ্জা বলে ভুল হতে পারে। এব্যাপারে একটা বাস্তব ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বেশ কয়েক বছর আগে আমার গ্রামে একজন অদ্ভুত মানুষের আগমন ঘটে, যে তার গুপ্ত অঙ্গকে গোপন রাখার কোন তাড়াই বোধ করতো না। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হবার কারণে সে এটা করতো। প্রথম লজ্জাটা না থাকলেও তার দ্বিতীয় লজ্জাটা ছিল টনটনে। কারও কাছে কিছুই চাইতো না সে, কারও উপর হামলেও পড়েনি কখনও। অতি নির্বিরোধ মানুষ ছিল সে। সম্ভবতঃ এই কারণে আস্তে আস্তে মানুষ তাকে একটু একটু করে পছন্দ করতে শুরু করে। কয়েকদিন পরে শ্রীমান দিগম্বরের ছোট ছোট কামালিয়াত আর মোজেজার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জলজ্যান্ত ল্যাংটা মানুষটা হয়ে গেল লেংটা শাহ। এলাকার সবথেকে বখাটে যে লোকটা সে এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করলো। রাতারাতি নিজের ভোলভাল পালটে, দাড়ি জোব্বা রেখে ল্যাংটা শাহের অভিভাবক ও খাদেম বনে গেল। তারপরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নেকবান খাদেমকে। ধনে মানে অনেক বড় হয়ে গেলেন তিনি রাতারাতি। আমার এলাকারও অনেক অগ্রগতি হলো। এখনও ভাবি, চক্ষুলজ্জা মানুষকে কত বড় করতে পারে, কোথায় পৌঁছে দিতে পারে! যদিও ল্যাংটা শাহের কর্মকাণ্ডকে দ্বিতীয় লজ্জা বলে ভাবার কোন সুযোগ নেই। বুদ্ধির কারণে তার নির্বিরোধী স্বভাবকে ছদ্ম-বিনয় হিসাবে ধরলেও সেটা যে এক ধরনের বিনয় তা মানতেই হবে।

image004

চক্ষুলজ্জার বিভ্রান্তির বিষয়ে আরেকটা কথা না বললে অনেক অপূর্ণতা থেকে যাবে। আফ্রিকার গভীর অরণ্যে অনেক উপজাতি নৃগোষ্ঠী আছে, যারা বস্ত্রের ব্যবহার জানে না বললে চলে। অর্থাৎ নিজেদের গুপ্ত অঙ্গ ঢেকে রাখার বিশেষ কোন তাগিদ তাদের নেই। কিন্তু নিজের দল বা গোষ্ঠীর ভালো মন্দ সব দায়-দায়িত্ব যার হাতে, সেই গোষ্ঠীপতি কিন্তু তার দলের জন্যে নিজের জীবনটা দিয়ে দিতে পারে। তাদের আহার যোগায়, অন্য গোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে নিজের লোকদের জান প্রাণ দিয়ে বাঁচায়। রাজা হিসাবে, দলপতি হিসাবে সবার কাছে নিজের মহত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে কি না সে করে। প্রথম লজ্জা না থাকলেও, দ্বিতীয় লজ্জা তথা চক্ষুলজ্জার কারণে সে সগোত্রীয়দের কাছে নিজেকে হীন করে না। এটা একটা প্রামাণ্য উদাহরণ মাত্র। কিন্তু এর থেকে যদি আমরা কিছু না শিখি তবে তা উদাহরণ হিসাবে বইয়ের পাতায়ই থেকে যাবে। যার হাতে ক্ষমতা থাকে তার লোক লজ্জা থাকা খুবই জরুরী, তা সে ক্ষমতার পরিমাণ যাই হোক। তবে যিনি রাজা, রাণী, প্রেসিডেন্ট, চ্যান্সেলর, মন্ত্রী, তার চক্ষুলজ্জা থাকতে হবে সর্বোচ্চে। তা না হলে- বাসে মানুষ পুড়বে, নির্দোষ পথচারী মরবে, ব্রিজ-সেতুসহ সমুদ্র চুরি হবে, শিল্প-কারখানা শ্রমিকসহ মাটির নীচে হারিয়ে যাবে, সব অঘটন ঘটবে ঐ রাজার কারণে। রাজা নিজ হাতে তা করবে চক্ষুলজ্জাহীনতার কারণে। গুপ্ত অঙ্গে তার যত লজ্জাই থাক, যত নিখুঁত আবরণী দিয়ে তা ঢাকা থাক, কোন কাজে আসবে না।

আপনাদের মতন আমারও ইচ্ছে করে ‘আমি রাজনীতি পছন্দ করি না’ বলে সাদা সার্ট গায়ে চাপিয়ে মুখে একটা সুশীল সুশীল ভাব এনে রাজপথ দিয়ে হেটে যেতে। কিন্তু পারি না তা, যখন দেখি কাপড় পরা চক্ষুলজ্জাহীন চারপেয়েরা বিপুল উৎসাহে রাজনীতির ছাতার নীচে এসে জড় হয়ে আমারই গায়ের কাপড় খুলে নিচ্ছে। এরাই তারা, যারা বঙ্গদেশের রাজনীতির বড় বড় খুঁটিগুলো আঁকড়ে ধরে আছে। এদের চোখের উপরে চামড়া নেই, তাই চোখের পলক পড়ে না। পলক পড়লে এরা বুঝতে পেত প্রতিটা পলকের পর চারদিক কতটা বদলাচ্ছে। চোখের পর্দা না থাকাটা এক ধরনের ইচ্ছা-অন্ধত্ব। এদেশের মাটি এক সময় ধুসর ছিল, এদের কারণে সেটা তামার রঙ ধারণ করেছে। এই প্রজাতির সরীসৃপদের এই মাটি থেকে উৎখাত করার থেকে আর কোন জরুরী কাজ বাঙালীদের থাকতে পারে না। এই ব্যাপারে সবথেকে বেশী যারা কাজে আসতে পারে তারা সুশীল সমাজ। কিন্তু এই ব্যাপারটায় তাদের মুখ একেবারে উল্টা দিকে ঘুরানো। এমন কোন দাওয়াই কারও যানা নেই, যা দিয়ে তাদের এই বাঁকা-মুখ রোগের আরোগ্য হতে পারে। তাদের সবচেয়ে বড় ভয় এইসব চর্মহীন চোখের সরীসৃপগুলো অপসৃত হলে সেই শূন্যস্থান কারা পূরণ করবে, কারা তাদের নিয়মিত মাশোহারা যোগাবে। চিন্তার বিষয় বটে! নিজেকে তারা কোনভাবেই রাজনীতিক হিসাবে ভাবতে পারেন না। ভাবতে পারেন না পতিত হতভাগা এক জাতির পরিচালক হিসাবে। নিজেদের অন্যের পোষ্য হিসাবে ভাবতে তাদের গর্বের সীমা নেই।

image002

আমাদের গ্রামদেশে একটা ব্রাত্য প্রবাদ আছে-‘হাইগা ছোচে না, মুইত্তা গলা পানি’। প্রবাদটি যত প্রাকৃতই হোক, এর ভিতর যে বাস্তবতা লুকিয়ে আছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। টিউমার মেলিগন্যন্ট হলে তা কেটে ফেলতে হবে, ভাবার কোন হেতু নেই টিউমার উৎখাতে তার শূন্যস্থান পূরণ কি দিয়ে করা হবে। মুখ্য কাজ উৎখাত, তার পরের চিন্তাটা গৌণ। সরীসৃপ উৎখাত করতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। অস্তিত্ব রক্ষার কাজটি মুখ্য, শূন্যস্থান পূরণ গৌণ। অথচ সেই গৌণ কাজ নিয়ে জ্ঞানজীবিদের কর্ম তৎপরতার শেষ নেই। যাই হোক, চক্ষুলজ্জা নিয়ে কথা হচ্ছিল, তাই নিয়েই কথা বলি। এই বঙ্গদেশের রাজনীতির খুঁটিগুলো যে সমস্ত চক্ষুলজ্জাহীন সরীসৃপেরা জড়িয়ে ধরে আছে তাদের রাজনীতিবোধ যদি উলঙ্গ ঐ আফ্রিকার গোষ্ঠীপতিদের কাছাকাছিও হতো তাহলে দেশের চেহারা অন্য রকম হতো। গুপ্তঅঙ্গ আবৃত না করেও, শুধু লোকলজ্জা ধারণ করার জন্যে তাদের অবস্থান নিঃসন্দেহে আমাদের থেকে অনেক উপরে। পোশাকহীন চক্ষুলজ্জাধারী মানুষকে সহ্য করা গেলেও, পোশাক পরা চক্ষুলজ্জাহীন বেহায়া মানুষ একেবারেই অসহ্য।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s