সবলের চৌহদ্দি


লিখেছেন- শেখ খলিল শাখা নির্ভানা

 

রাজপুত্র বা রাজা হবার স্বপ্ন তার মাথায় আসতো না, ভুলেও আসতো না। সকাল বিকেল গোলপাতার ছাপড়ায় বসে ছোট ছোট ছাত্র পড়িয়ে খিদে পেটে, মুখে পচা দুর্গন্ধ নিয়ে বাড়ি ফিরে কিছু একটা খেয়ে নেয়া আর তারপরে আরও কিছু ঘর-গেরস্থলির কাজ করা, এই ছিল তার প্রতিদিনের রঙচটা স্বপ্ন। সারাটা জীবনের জন্যে সে ঐ টুটাফাটা বেসরকারি প্রাইমারীর সাথে বাঁধা থেকে গেলো। সেই বাঁধন সে কোনকালে কাটাতে পারেনি, কাটাতে চায়ওনি। সুযোগ পেলেই সে মানুষের মনুষ্যত্বের কথা বলতো, পশুত্বের গল্প যেতো বেবাক চেপে। বউয়ের দেয়া আকামা মিনসে উপাধিটাও চাপতো ভয় তরাসে। একবার হলো কি, বন্যার সময় নিজের এলাকায় রিলিফ বাটার একটা ভার এসে পড়লো মাস্টারের উপরে। সেই ভার ছিল তার কাছে হিমালয়ের থেকেও দেড়ি। সব ঠিকঠাক মতন হলো, শুধু মাস্টার নিজের বাড়ির কথা গেল ভুলে। শেষে সব জানতে পেরে, ক্ষুধায় ক্ষিপ্ত হয়ে যখন তার বউ এলো তেড়ে, তখন সে দৌড়ে পড়শি বাড়ি গিয়ে কিছু চাল-ডাল নিয়ে এলো ধার করে। এই হচ্ছে ক্ষুন্নিপাশা গ্রামের আবেদুর মাস্টার। মানুষের জীবনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু অলৌকিক ঘটনা ঘটে কয়জনের ভাগ্যে? মাস্টারের জীবনে একবার এমন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো, যা সে এখন মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে এইভাবে- সে এক আকালের ক্ষতরে ভাই, অনেক কষ্টে জানটারে বাঁচাইছি। যাইহোক এখন গায়েবী সেই ঘটনার কথা বলি। কোন এক অলক্ষুণে সন্ধ্যায় বাগানে তিন বছুরে ছেলেটার জন্যে পায়খানার গর্ত খুড়তে গিয়ে মাস্টার পেলো একটা পিতলের পুরানো রঙওঠা প্রদীপ। সেটা একপাশে রেখে কাজ শেষ করলো আবেদুর মাস্টার। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমুতে যাবে এমন সময় মনে পড়লো তার সেই পুরানো প্রদীপের কথা। না শুয়ে বাগান থেকে প্রদীপটা ধুতে নিয়ে এলো পুকুর ঘাটে। পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলো সেটা। মাটি তো গেল, কিন্তু মরচেটা গেল না আর। প্রদীপটা দেখতে সুন্দর। যাক ভালই হলো, পুরানো টেমিটা ফেলে এবার এইটা সে জ্বালবে প্রতিদিন- ভাবলো মাস্টার মনে মনে। কোমর থেকে চাবি টেনে এনে প্রদীপের গায়ে দিলো এক ঘসা। ছোট্ট একটা ধাতব শব্দ, তারপর চারদিক তোলপাড় করে বিকট এক ঝড়ো শব্দে সামনে এসে দাঁড়ালো একটা পর্বত-মানব। একি মানুষ না দৈত্য! মাস্টার বেহুশ হবার জোগাড়। দৈত্য কুর্ণিশ করে বললো- আমি এখন থেকে আপনার দাস, যা চাইবেন তাই এনে দিব। আদেশ করেন প্রভু।

আবেদুরের মুখ দিয়ে বিস্ময়ে কথা সরে না। বিড়বিড়িয়ে বললো- প্রভু, দাস, আদেশ, এইসব কি? আমার কিছু চাই না, কিচ্ছু না। তুমি যাও। তুমি যাও।

-হীরক, সোনা, রুপা, দামী খাবার, দামী কাপড় কিচ্ছু না?

একটু কৌতূহল হলো মাস্টারের মনে। সাহস নিয়ে বললো- আনো তো সোনা, কেমনে আনো। মুহূর্ত যেতে না যেতে পুকুর পাড় সোনায় সোনায় ভরে যেতে লাগলো। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো আবেদুর মাস্টার- আরে আরে থামো, আর দেখাতে হবে না। বেহুশ হয়ে যাবার মতন একটা ভাব এলো, একটু বমিবমিও আসতে লাগলো তার। দৈত্যের শক্তিতে বিশ্বাস এলো মাস্টারের মনে। ধাতস্থ হলো এবার মাস্টার। নিজের মধ্যে ফিরে এলো সে। এই সোনা দিয়ে সে কি করবে? কার না কার জিনিস! সোনায় লোভ আছে তার বৌয়ের, সে এসব পেলে খুশি হতো, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। এগুলো দৈত্যকে ফেরত নিতে হবে। সে আসলেই আকামা। তার বউই হয়তো ঠিক। মানুষের গল্প, মনুষ্যত্বের গল্পের কথা মনে আসতে লাগলো তার বারবার। ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগে নদী যেমন থমথমে স্থির হয়ে যায় তেমনি হয়ে থাকলো তার মনটা।

-দৈত্য, তুমি এই সোনাগুলা এখন অদৃশ্য কইরা দাও, আর আমার জন্যে তিনখানা কাম করো।

-তথাস্থ। বলেন কি কাজ করতে হবে।

-প্রথম কাজ, আমার ইশকুলে ক্লাস ফাইবের রেজাউলের পড়াশুনার ভীষণ ইচ্ছা, কিন্তু সে অংক আর বিজ্ঞান কিছুই বুঝে না। তারে তুমি এমন ভাল ছাত্র বানাইয়া দাও, যাতে সে আগামীতে অংকে আর বিজ্ঞানে একশ কইরা পায়। দ্বিতীয় কাজ, আমার প্রতিবেশী হাসুর মা ভিক্ষা করে। তার ছেলে ভাল কাজ পাইছে, তারপরেও ভিক্ষা করে। হাসুর মার মনে আত্মসম্মান জাগাইয়া দাও, যাতে সে আর ভিক্ষা না করে। আর তিন নম্বর কাজটা হইলো- আমার বউয়ের, মানে আমাগো কামাল পাশার মায়ের স্বভাব চরিত্রটা ভাল কইরা দাও, যাতে সে আমারে আর আকামা মিনসে না কয়।

তথাস্থ্য বলে দৈত্য অদৃশ্য হয়ে গেলো। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, চল্লিশ মিনিট চলে যায় দৈত্য আর ফেরে না। টানা দেড় ঘণ্টা বাদে দানো এসে হাজির। চোখ মুছতে মুছতে মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ালো সে মাস্টারের পাশে। এতবড় এক প্রাণীর এই নাকাল দশা দেখে আবেদুর মাস্টারের বিস্ময়ের আর শেষ রইলো না। চোখ ডলতে ডলতে দৈত্য বললে- প্রভু আমারে মাফ কইরা দেন। এই কাজ আমার দ্বারা সম্ভব না। এইটা আমার ক্ষমতার বাইরে। তয় আমার মনে হয়, এই ক্ষমতা আপনার আছে।

-তাইলে তুমি কিসের দানো। যাও তুমারে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আর শুনো, যাওয়ার সময় ঐ প্রদীপটাও নিয়া যাও।

দৈত্য চলে গেলো কাঁদতে কাঁদতে। আবেদুর মাস্টার পা টানতে টানতে এসে ঢুকলো তার পর্ণকুটিরে। দরজা খোলার কটকট আওয়াজ শুনে মাস্টারের বউ জ্বলে উঠলো ঘরের এক মাত্র পুরানো টেমিটার মতন- আকামা মিনসে আইলা তাহলে? কার গুষ্টি উদ্ধার করা হইতেছিল বাগানে বইয়া, শুনি।

আবেদুর মাস্টার রাগ করলো না, কোন কথাও বললো না। মুখরা স্ত্রীর পাশে কাঁচুমাচু করে শুয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবলো- ঠিকই তো বলেছে তার বউ। সে তো আকামাই। আকামা না হলে কেউ কি সোনা-রূপা ফেরত দিয়ে দেয়!

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s